‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : Parstoday
শনিবার

১৮ ডিসেম্বর ২০২১

৮:২১:৪৩ PM
1209937

সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা (সা)'র শাহাদাত

সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমার (সা) শাহাদাত শীর্ষক আলোচনা। নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা জাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)'র শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা। হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক ।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা) : তিনি  ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ অনেক মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁকে সর্বযুগের নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা  আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী- উল্লেখ করেছেন।

অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহিয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত। রাসূলের পুত্র সন্তানরা মারা যাওয়ায় ইসলামের শত্রু কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকরা এ নিয়ে ঠাট্টা করত। আস ইবনে ওয়ায়েল রাসূলকে ‘আবতার’ বা ‘লেজকাটা’ তথা নির্বংশ বলে গালি দিত। ফলে মনে মনে খুব কষ্ট পেতেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) । মহান আল্লাহ্ তাঁর এ কষ্ট দূর করার জন্য যে অমূল্য নেয়ামত তাঁকে দান করেন তিনিই হলেন হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) । এর প্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনে সুরা কাওসার নাযিল হয়। মহান আল্লাহ সুরা কাওসারে বরকতময় এই জন্মের সুসংবাদ দেন এভাবে: আমরা তোমাকে কাওসার বা বরকতময় প্রস্রবন দান করেছি। তাই তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ আদায় কর ও কুরবানি দাও। নিশ্চয়ই তোমার শত্রুরাই হচ্ছে নির্বংশ। 

মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’

আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেছেনহযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেনঅনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছেঅন্যদিকে বনি উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।

ইসলামের যেসব শত্রু পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মহানবীর আহলে বাইতের  বংশধারায় জন্ম নেয়া ১১ জন পবিত্র ইমাম হযরত ফাতিমা তথা মহানবীরই বংশধর। এ বংশধারাতেই শেষ জামানায় ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

হযরত ফাতিমা  ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ,বিশ্বস্ততা,অন্যায়ের ব্যাপারে  আপোষহীনতা,সততা,দানশীলতাধৈর্য,চারিত্রিক পবিত্রতা,লজ্জাশীলতা  আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ অনেক মহৎ গুণের আদর্শ আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট আজ জাকিয়া বা সতীমুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আজ যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি 

হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।

রাসুল (সা)র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা।  ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যত বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।

হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে বাতুল উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। হযরত ফাতিমা কাছে এলে দ্বীনের নবী নিজে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে বরণ করে নিজের পাশে বসতে দিতেন। এ থেকে বোঝা যায় ফাতিমাকে সম্মান দেখানোর পেছনে রয়েছে ঐশীলোকের সুস্পষ্ট ইংগিত।

হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। 

দুনিয়া থেকে মহানবীর দৈহিক বিদায়ের মাত্র দুই মাস বা মতান্তরে ৯৫ দিন পর শাহাদাত বরণ করেন হযরত ফাতিমা।

কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। 

অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে  অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে।

ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবিশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। এতে কিয়ামত পর্যন্ত যা যা ঘটবে তার বর্ণনা ও সব শাসকদের নাম লেখা আছে বলে মনে করা হয়। হযরত ফাতিমা  ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।

হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।

নবী-নন্দিনী (সাঃ) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সাঃ)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়।

ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে  অনন্য। হজরত ফাতিমা(সা)  আদর্শ মানবাত্মার প্রতীক।  তাঁর প্রতি জানাচ্ছি অশেষ দরুদ ও সালাম।#

342/