‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ABNA
শুক্রবার

১০ মার্চ ২০২৩

১২:৪৩:২৯ AM
1351461

ইমামে মাহদির (আ.) আবির্ভাবের জন্য শীয়াদের অবশ্যই বিকাশ ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছাতে হবে : মুস্তাফা ওয়ার্মেযিয়ার

মাহদাভিয়াত বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি বলেন: শীয়ারা ইমামে যামানের (আ:) অভ্যুত্থান ও প্রতিরোধ-আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিকাশ লাভ করা প্রথম ফুলকুঁড়ির মত। রেওয়ায়েত সমূহের বর্ণনা অনুসারে, শেষ জামানায় জনগণের উপর এত বেশী নিপিড়ন চালানো হবে যে, ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠাকারী একজন পবিত্র ব্যক্তির আবির্ভাবের জন্য, সবাই বিচলিত হয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকবে।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): মধ্য-শা'বানে ইমামে জামানের (আ.) জন্ম বার্ষিকীতে, মাহদাভিয়াত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবনার সাংবাদিকগণ বৈঠক করেন।  সেই সূত্রে আবনা-প্রতিবেদকগণের সাথে হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন "মুস্তফা ওয়ার্মেযিয়ার" এর যে কথোপকথন হয়, সেখানে ইমাম জামান (আ.) কেন গেইবাতে (অন্তর্ধানে) থাকতে বাধ্য হয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়ার্মেযিয়ার বলেন: ইমামত বা নেতৃত্বের বিষয়ে ইমামের মূলনীতি হচ্ছে, ইমামকে সমাজিক জীবন যাপন করতে হবে এবং সমসাময়িক মানুষের সাথে বসবাস করতে হবে। কিন্তু তখনকার পরিবেশ ও পারিপার্শিক অবস্থা এতটাই নাজুক ও বিপদজনক হয়ে উঠে ছিল যে, ইমামকে বাধ্য হয়েই গেইবাতের জীবন বেছে নিতে হয়েছে।

ইমামের গেইবাত সম্পর্কে তিনি আরো বলেন: ইমামের গেইবাত বা অনুপস্থিতির মূল কারণ ছিল- তার উপর আসা সেই মহা-বিপদ। এটা ঠিক যে, সেই সময়কার অত্যাচারী শাসকদের পক্ষ থেকে ঐ বিপদ এসেছিল, তবে তার গেইবাতের অন্য কারণগুলির মধ্যে শীয়াদের সংখ্যালঘুতা এবং বিশ্বাস ও প্রশিক্ষণের দিক থেকে তাদের অপরিপক্কতাও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কারণ তারা সংখ্যার দিক থেকে যেমন কম ছিল, তেমনি বিশ্বাসের দিক থেকেও ছিল শিক্ষা-নবিন ও অপরিপক্ক।

মাহদাভিয়াত বিষয়ের এই বিশেষজ্ঞ বলেন- “ইমামে জামানের (আ.) আবির্ভাবের জন্য শীয়াদের অবশ্যই বিকাশ ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছাতে হবে কিন্তু কাঙ্খিত সেই বিকাশ ও সমৃদ্ধি এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়নি”। শীয়াদের এই বিকাশ ও সমৃদ্ধি অবশ্যই তাদের ভিতর থেকে হতে হবে এবং বিশ্বাসের দিক থেকে তাদেরকে এমন এক অবস্থায় পৌঁছাতে হবে, যেখানে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য তারা সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। শীয়াদেরকে অর্থ-সম্পদের বিষয়ে, এমন হতে হবে যেন তারা বিষয়-সম্পত্তিকে নিজের মনে না করে। শীয়াদের আর্থিক সহযোগিতা করার মানুষিকতা সম্পর্কে কিছু হাদিসের বর্ণনায় জানতে চাওয়া হয়েছে, আর্থিক সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান কেমন? উত্তরে যখন বলা হয়েছে, আমাদের কিছু লোক আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। তখন হযরত বলেন- যারা আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে, তারা জীবন উৎসর্গ করার ক্ষেত্রে আরো বেশি বখিল এবং অসহযোগিতার বিষয়ে অধিক অগ্রগামি।

প্রসিদ্ধ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি; ইমাম বাকিরের (আ.) একজন সাহাবী বলেন: আমাদের মধ্যে কিছু লোক এমন ভাবে তৈরী হয়েছে যে, বড় কোন কিছু (বিপ্লব) করার জন্য তারা যথেষ্ট বলে গন্য হবে, তার পরও কেন আপনি কিয়াম করছেন না?

হজরত জবাবে কারণ উল্লেখ করে বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এমন আছে যে তার ভাইয়ের পকেট থেকে প্রয়োজন মত তুলে নিতে পারবে? অথচ সে তাতে বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হবে না? সত্যিই কি তোমাদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে? সাঈদ বিন হাসান বলেন, আমি শিয়াদের মধ্যে এমন নীতি-নৈতিকতার দেখা পাইনি। তখন ইমাম বলেন- তাহলে এখনও তেমন কিছু করার সময় আসেনি।  বর্ণনাকারী বলেন, এই যখন অবস্থা, তাহলে কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? হযরত তখন বলেন:  শিয়ারা এখনও কাঙ্খিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানগত পরিপূর্ণতায় পৌঁছায়নি। হজরতের উদ্দেশ্য এখানে সম্পত্তির মালিকানা আইন লঙ্ঘন করা নয়, বরং তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন যে, নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌছানোর পথে সম্পদ-সম্পত্তির বিষয়গুলো যেন তোমার বা আমার হওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে ওঠে।

তিনি আরো বলেন: অন্য রেওয়ায়েতে “অর্থ-সম্পদের বিষয়ে শীয়াদের নীতিমালা কেমন হওয়া উচিত” তা সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ধনী-ব্যক্তির সম্পদে গরীবদের কতটুকু অধিকার রয়েছে কিংবা আদের তাদের কোন অধিকার রয়েছে কি না ইত্যাদি।

উপরোক্ত বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে যখন বর্ণনাকারী বলেন- না, আমাদের শিয়াদের মধ্যে এ ধরণের আচারণের কোন প্রচলন নেই! তখন হযরত বলেন: এরা শিয়াদের অন্তর্ভূক্ত নয়।

অতএব, ইমামের আবির্ভাবের প্রথম শর্তগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে, বস্তুগত বিষয়ে শীয়াদের নিজেদের মধ্যে তোমার-আমার বিষয় থাকা উচিত নয়, এখনও পর্যন্ত আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। শুধু যে সমাজ এই পর্যায়ে পৌঁছায়নি তা নয়, আমাদের বিশেষ ব্যক্তিরাও এই স্তরে নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ার পদ-মর্যাদা ও কর্তৃত্ব আমরা নিজেদের জন্য চাইব এবং আমাদের লক্ষ্য কী অথবা আমাদের কোথায় যেতে হবে সেই চিন্তায় না থাকব, ততদিন আমাদেরকে ইমামের আবির্ভাবের জন্য কেবল অপেক্ষা করেই থাকতে হবে।

হোজ্জাতুল ইসলাম ওয়ার্মেযিয়ার আরো বলেন: ইমামের প্রতি অনুগত থাকার অন্যতম শর্ত হচ্ছে দুনিয়ার প্রতি লোভী না হওয়া । আলহামদুলিল্লাহ, ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা এই শর্ত পূরণ করেছেন। তাঁর পরিবারের এবং তাঁর নিজের নৈতিকতা ও চরিত্রের জন্য মানুষ অনেক প্রশংসা করে থাকে। তবে ইসলামী সরকারের অন্য সকল কর্মকর্তাদেরও এইরুপ আত্ন-সংশোধনে পৌঁছাতে হবে যেন রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং গভর্নরগণ দুনিয়া-লোভী না হওয়ার শর্ত পূরণ করতে পারেন। তারা আসবেন জনগনের সেবা করতে, এমন যেন না হয় যে, তাদের লক্ষ্য বর্তমান পদ-মর্যাদা ব্যবহার করে অন্য জায়গায় পৌঁছানো! যতক্ষণ না আমরা সবাই এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারছি, ততদিন সরকারি ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা হতেই থাকবে। অল্প কিছু লোকের স্বার্থপরতা এবং দুনিয়র প্রতি লোভ থাকার কারণে; আমাদের বেশিরভাগ সমস্যাগুলো পড়ে থাকে এবং বেশীর ভাগ মানুষ উপকৃত হতে পারে না।

আবির্ভাবের যুগে বিশ্ব-বাসির অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন: শীয়ারা হযরত ইমামের (আ:) অভ্যুত্থান ও প্রতিরোধ-আন্দোলনের সর্বপ্রথম বিকাশ লাভ করা ফুলকুঁড়ি। অন্য রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুসারে, শেষ জামানায় জনগণের উপর এত বেশী চাপ ও নিপীড়ন হবে যে, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বিচলিত চিত্তে একজন ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠাকারী পবিত্র ব্যক্তির আবির্ভাবের জন্য প্রতিক্ষার প্রহর গুনবে এবং যারা অহংকার করে হযরতের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা ধ্বং হবে। সে সময় অধিকাংশ মানুষ সত্য ও ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকবে এবং হযরতের আন্দোলনকে সমর্থন করবে। অন্য রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে- ইমামদের অনুসারী দাবীদারদের কেউ কেউ নিজেদেরকে কাফেলার পিছনের সারিতে সরিয়ে রাখবে, কিন্তু মুসলিম নয় এমন অনেক মানুষ এই কাফেলার সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করবে!

মাহদাভিয়াত বিষয়ের এই গবেষক আরো বলেছেন: অন্য একটি রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে- "সূর্য উপাসক এবং চন্দ্র উপাসকদের অনেকেই হযরতের মহান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবে এবং বিশ্ব জনমত তাঁর সাথে থাকবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, হযরতের আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় শীয়াদেরকে থাকতে হবে। শীয়ারা যখন নিজেদেরকে সঠিক ভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে, তখন তারা বিশ্বকে গড়ার মত বড় দায়িত্ব যথাযত ভাবে পালন করতে পারবে এবং সফল হবে।

বর্তমানে, ইরানের সাথে অত্যাচারী ও নিপীড়ক শাসকদের এত সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে তারা চায় না আমাদের দেশ একটি সফল ধর্মীয় সরকারের আদর্শ হিসাবে টিকে থাকুক এবং সবার সামনে উপস্থাপিত হোক। যদি ইরানকে একটি সফল আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে উপস্থাপন করা হয় তাহলে অনেক দেশ আমাদেরকে অনুসরণ করতে শুরু করবে।

তিনি শেষ যামানার অত্যাচার ও অবিচারের ব্যাপকতা সম্পর্কে বলেন: জনগণের উপর চাপ বলতে, অযোগ্য সরকার কর্তৃক চালানো নির্যাতন ও নিপীড়নকে বুঝানো হয়েছে। জানি না শেষ যামানার এই অত্যাচারী সরকার কোন দেশের, তবে তাদের অত্যাচার ও নিপীড়ন এতটাই ব্যাপক হবে যে, মানুষ ক্লান্ত হয়ে একজন ত্রাণকর্তার সন্ধান করতে থাকবে, তারা যখন ত্রাণকর্তাকে চিনতে পারবে, তার সাথে হাত মিলাবে। স্বভাবতই, কিছু লোক তাদের অবৈধ স্বার্থের জন্য ত্রাণকর্তার উপস্থিতিকে হুমকিস্বরুপ মনে করবে এবং তারা তার বিরোধিতা করা শুরু করবে। বিষয়টা এমন নয় যে, হযরতের আবির্ভাবের সাথে সাথেই একটি বিশ্ব সরকার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। যেমন একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, প্রায় ছয় মাস যুদ্ধ হবে; কোন কোন রেওয়ায়েত অনুযায়ী পৃথিবীর কত শতাংশ মানুষ নিহত হবে তা বলা হয়েছে, তবে আমরা সেই দিকে না গিয়ে বলতে চাই, যারাই হযরতের মোকাবেলায় কঠোর ভাবে দাঁড়াবে তারা নিশ্চিত ভাবে ধ্বংস হবে।

পরিশেষে, হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়ার্মেযিয়ার বলেন: শিয়া হিসেবে আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের মানুষদের এমনভাবে জীবনযাপন করা উচিত, যাতে ইমাম জামান (আ.) আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন এবং তাঁর আবির্ভাবকে আমরা তরান্বিত করতে সক্ষম হই। যদি আমরা নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে আমাদের চারপাশের মানুষদেরকেও তাঁর আবির্ভাবের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারব (ইনশাআল্লাহ)।