জেনারেল কাসেম সোলাইমানি এবং আবু মাহাদি আল-মুহান্দিস দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাদের জীবন নিপীড়ন ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তাদের জাতীয়তার ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই দুই ব্যক্তি মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা,সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য অভিন্ন পথে হেটেছেন। জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত তাদের জীবন কাহিনী উৎসর্গ ও ত্যাগে পরিপূর্ণ। পার্সটুডের আজকের নিবন্ধে পশ্চিম এশিয়ার বিশিষ্ট এই দুই ব্যক্তিত্বের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হল:
প্রথম অধ্যায়:তাদের প্রাথমিক জীবন
১৯৩০ এর দশকে পশ্চিম এশিয়ার দুটি ভিন্ন স্থানে দুটি শিশুর জন্ম হয়। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরমানের "কানাত মালিক এলাকার একটি দরিদ্র গ্রামের শিশু কাসিম একটি ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কেরমানের শুষ্ক পাহাড়ে একটি সরল জীবন তাকে কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় শিখিয়েছিল। একই সময়ে জামাল জাফর যিনি পরে আবু মাহাদি আল-মুহান্দিস নামে পরিচিত ছিলেন তিনি ইরাকের বসরায় একটি ধর্মীয় শিয়া পরিবারে বেড়ে উঠছিলেন। সাদ্দাম সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়নের যাতাকলে পিষ্ট এক ভয়ানক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন জামাল। কাসেম যখন শ্রমিক হিসাবে কাজ করছিলেন এবং তার পরিবারকে সহায়তা করার জন্য নির্মাণ কাজ করছিলেন তখন জামাল বসরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছিলেন। কিন্তু উভয়ই একটি সাধারণ স্থানে মিল ছিলেন। তা হচ্ছে নিরাপত্তার জন্য সংগ্রাম।
দ্বিতীয় অধ্যায়: কমান্ডারদের জন্ম
কাসেম সোলেইমানি ১৩৫৯ সালে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে যোগদান করেন যেখানে তার সামরিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল। ইরান এবং সাদ্দামের বাথ গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ ৪১তম থারুল্লাহ ডিভিশনের কমান্ডার হিসাবে অপারেশন পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতা দেখানোর জন্য তার জন্য একটি সুযোগ ছিল। ইরানের পশ্চিম সীমান্ত থেকে শুরু করে প্রধান আঞ্চলিক যুদ্ধের প্রথম সারিতে তিনি একজন বিশিষ্ট কৌশলবিদ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে আবু মাহদি আল-মুহান্দিস ইরাকের ইসলামিক দাওয়া পার্টিতে যোগ দিয়ে সাদ্দামের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ইরাকে শিয়া দমন-পীড়ন যখন চরম আকার ধারন করেছিল তখন তিনি ইরানে হিজরত করতে বাধ্য হন। ইরানে আল-মুহান্দিস সাদ্দাম বিরোধী সংগঠনগুলোর কাছে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন এবং বাথ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি প্রতিরোধকামী নেটওয়ার্ক তৈরি করেন।
তৃতীয় অধ্যায়: যুদ্ধের ময়দানে
কয়েক বছর পর এই দুই কমান্ডার অভিন্ন শত্রু আইএসআইএ'র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হন। আইএসআইএস একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যারা ২০১৪ সালে ইরাক এবং সিরিয়ার বিশাল অংশ দখল করে ধর্মের নামে সবচেয়ে নৃশংস অপরাধযজ্ঞ চালিয়েছিল। যখন দায়েশের হাতে বাগদাদ পতনের দ্বারপ্রান্তে ছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ গণহত্যার ঝুঁকিতে ছিল তখনই ইরাকে যুদ্ধের সমীকরণ পাল্টে দেন জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। তিনি আট বছরের অভিজ্ঞতা এবং প্রতিরোধ অক্ষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক নিয়ে ইরাকে আসেন। বাগদাদে তিনি হাশদ আল-শাবি বাহিনীর কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন যিনি তার সাবেক সহকর্মী এবং বন্ধু ছিলেন। তাদের বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং অভিন্ন উদ্দেশ্যের উপর নির্মিত তাদের এই পথ চলার সংগ্রামী পথ এই অঞ্চলের ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায়: সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ
যুদ্ধক্ষেত্রে জেনারেল সোলাইমানি শুধু একজন কমান্ডার হিসেবেই নয় একজন অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের বিভিন্ন দলকে একত্রিত করেছিলেন। অন্যদিকে আল-মুহান্দিস যার বাহিনী সংগঠিত করার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত দক্ষতা ছিল তিনি জনপ্রিয় বাহিনীকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিকরিত, ফালুজা, মসুল এবং অন্যান্য অধিকৃত শহরগুলোকে দায়েশমুক্ত করার অভিযানগুলো উভয়ের মধ্যে অনন্য সহযোগিতার প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রতিটি যুদ্ধে সৈন্যদের মনোবল বাড়াতে খাকি জুতা ও পরামর্শমূলক নোট নিয়ে জেনারেল সোলাইমানি যুদ্ধের সামনের সারিতে ছিলেন। আল-মুহান্দিস তার দক্ষ ব্যবস্থাপনার কৌশল ব্যবহার করে যুদ্ধের রসদ এবং জনবল সরবরাহ করতেন। তাদের জন্য স্মরণীর মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি ছিল আমেরলির অবরুদ্ধ এলাকায় তাদের বৈঠক। চারদিকে বিপদ সত্ত্বেও জেনারেল সোলাইমানি এবং আল-মুহান্দিস ব্যক্তিগতভাবে এলাকায় প্রবেশ করেন এবং অবরোধ ভেঙ্গে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযান কেবল একটি সামরিক বিজয় ছিল না বরং তা মানুষের মধ্যে আশা ও উদ্দীপনা পুনরুজ্জীবিত করেছিল।
পঞ্চম অধ্যায়: তাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা
আইএসআইএসের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধের নায়ক হিসেবে এই দুই কমান্ডারের প্রভাব বেড়ে যায়। এ বিষয়টি তাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। রেছেের প্রভাব বেড়ে যায়। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারির সকালে যখন জেনারেল সোলাইমানি একটি অফিসিয়াল বৈঠকের পরে বিমানে বাগদাদে পৌঁছান তখন তার বহর এবং আল-মুহান্দিসকে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন বাহিনীর ড্রোন হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। বিস্ফোরণের পর এই দুই কমান্ডারকে বহনকারী গাড়িটি পুড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তাদের শাহাদাতের খবরে সারা বিশ্বে ক্ষোভ ও শোকের ছায়া নেমে আসে।#