২ জুলাই ২০২৫ - ১৩:৪৫
Source: Parstoday
লিওয়ের কসাই থেকে গাজার কসাই: ইতিহাসে বারবার অপরাধীদের বাঁচিয়েছে আমেরিকা

পার্সটুডে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আমরা লিওয়ের কসাই হিসেবে পরিচিত ক্লাউস বার্বির নাম সামনে আসে। কসাই হিসেবে পরিচিত এই ক্লাউস বার্বিকেও মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ তাদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল।

পার্সটুডে জানিয়েছে- ৩৮ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে  "লিওয়ের কসাই" নামে পরিচিত নাৎসি যুদ্ধাপরাধী ক্লাউস বার্বিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফরাসি আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। লিও শহরে জার্মান গুপ্ত পুলিশের প্রধান ছিলেন বার্বি, যিনি কমপক্ষে ৭,৫০০ ফরাসিকে মৃত্যু শিবিরে পাঠিয়েছিলেন এবং প্রায় ৪,০০০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। লিওয়ের কসাই প্রায় দুই বছর ধরে জার্মানিতে আমেরিকার গোপন এজেন্ট ছিলেন এবং আমেরিকা তাকে আর্থিক সহায়তাসহ সব ধরণের সহযোগিতা দিয়েছেন।

"লিওয়ের কসাই" নামে পরিচিত ক্লাউস বার্বি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের লিও শহরে গেস্টাপো (নাৎসি গোপন পুলিশ) প্রধান ছিলেন, যাকে ফরাসি প্রতিরোধ ধ্বংস  করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বর্বরতার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেন। কখনো কখনো তিনি নিজেই বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালাতেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেন। বিভিন্ন সূত্র মতে, লিওয়ের এই কসাই ফরাসি প্রতিরোধের নেতা জিন মোলিনকে গ্রেপ্তারের পর নিজেই তাকে নির্যাতন ও লাথি মেরে হত্যা করেছিলেন।

যুদ্ধের শেষে তিনি জার্মানিতে ফিরে আসেন এবং হিটলারের পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি নিজের অপকর্ম সংক্রান্ত সব নথি ধ্বংস করে ফেলেন। ভিন্ন নাম এবং পরিচয়ে নতুন জীবন শুরু করেন।

যুদ্ধের পরে লিওয়ের কসাইকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজে লাগাতে শুরু করে। কমিউনিস্ট নেটওয়ার্কগুলোর বিষয়ে তথ্যদাতা হিসেবে নিয়োগ দেয় আমেরিকা। এরপর তারা তাকে নিরাপত্তা দেয় এবং জার্মানির মার্কিন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে একটি মিথ্যা পরিচয়ে বসবাস সুযোগ দেয়। ১৯৫১ সালে বার্বি দক্ষিণ আমেরিকায় পালিয়ে বিচার থেকে বাঁচতে হয়। তিনি বলিভিয়ায় কয়েক দশক ধরে প্রকাশ্যে বসবাস করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে ফ্রান্স তাকে ফেরত আনতে সক্ষম হয় এবং ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে বার্বিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ফরাসি সংবাদমাধ্যম বার্বিকে "লিওয়ের কসাই" বলে অভিহিত করে এবং ফরাসি আদালত তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে (তখন ফরাসি আইন মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হয়েছিল) দণ্ডিত করে। লিওয়ের কসাইয়ের বয়স তখন ৭৩ বছর। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯৯১) কারাগারেই ছিলেন এই খুনি।

"লিওয়ের কসাই"-এর বিচারকে আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমেরিকা সেই খুনিকে নিয়োগ ও রক্ষার কথা স্বীকার করেছে এবং এ জন্য ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু এমন অন্যায় কি ক্ষমার যোগ্য?

এবার গাজার কসাইয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক

লিওয়ের কসাইয়ের বিচারের এত বছর পর মার্কিন সমর্থনে আরেকজন কসাই আবির্ভূত হয়েছে ভিন্ন নামে, ভিন্ন উপাধিতে এবং ভিন্ন স্থানে। আর এই কসাই আর কেউ নন,  তিনি হলেন ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজার কসাইয়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাজায় মানুষ হত্যা করছে, নেতানিয়াহু'র বাহিনীকে অস্ত্র দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক ফোরামে দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যেকোনো প্রস্তাব ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করছে এবং ইদানিং দাবি করছে যে, তারা দখলদার ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিচ্ছে।

ইসরাইলের কসাই নেতানিয়াহু শুধুমাত্র ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ৫৬ হাজারের ৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৪২ জন আহত করেছেন। গণহত্যার পর গণহত্যা চালানো নেতানিয়াহুর নেশায় পরিণত  হয়েছে।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণা সত্ত্বেও গাজার কসাই এখনও গাজার ধ্বংসস্তূপে রক্তের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে এবং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ক্ষুধার্ত মানুষ জড়ো করে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। এ পর্যন্ত শত শত ত্রাণপ্রার্থীকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। 

মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও দখলদার ইসরাইল মিলে গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) এর নামে ত্রাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে সীমিত পরিমাণে কিছু ত্রাণ বিতরণ শুরু করে। এটা এক ভয়াবহ মৃত্যু ফাঁদ, কিছু খাবার দেওয়ার জন্য ক্ষুধার্ত মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। একটি বড় মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে এই ত্রাণ কেন্দ্র। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা যারা সাহায্য নিতে জড়ো হন, কসাইয়ের নির্দেশে তাদের ওপর দখলদার বাহিনী গুলি চালায়। এর ফলে কেউ দৌড়ে পালায়, কেউ গুলিবিদ্ধ হয়, কেউ মারা যায়। কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে পালায়, কেউ হয়তো বন্ধু বা অপরিচিত মানুষের সাহায্যে বাঁচে, আর কেউ একাকী রক্তে ভিজে মাটিতে পড়ে থাকে। মে মাসের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত সাহায্য কেন্দ্রে গুলিবর্ষণের ঘটনায় পাঁচশ'র বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন । আহত হয়েছেন চার হাজারের বেশি গাজাবাসী। গাজাবাসীকে কম খরচে হত্যা করতে ত্রাণ কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছে তারা, এর আগেই তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে UNRWA-এর মতো বিশ্বস্ত সংস্থার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে কসাই বাহিনী।

বিশ্ববাসী অপেক্ষা করছে, গাজার কসাই নেতানিয়াহুর বিচার দেখার জন্য। আসলেই কি এই কসাইয়ের বিচার হবে নাকি ওয়াশিংটনের সহায়তায় গাজায় গণহত্যা চলতেই থাকবে?#

Your Comment

You are replying to: .
captcha