ইহুদিবাদ ও এর সহযোগীদের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনিদের গত এক বছরের সংগ্রামী অভ্যুত্থানের যে বিশাল বাস্তবতা তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা আজ খুব জরুরি। ইরানের ইসলামী সংস্কৃতি ও যোগাযোগ সংস্থার প্রধান মোহাম্মাদ মাহদি ইমানিপুর এ প্রসঙ্গে 'বড় ও বৃহত্তর পরাজয়' শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি সম্প্রতি দেশটির ফার্স প্রদেশের ১৫ হাজার শহীদদের স্মরণে আয়োজিত সমাবেশের কর্মী ও আয়োজকদের দেয়া এক সাক্ষাতে এ অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ, প্রতিরোধ-সংগ্রাম ও এ সংক্রান্ত প্রচেষ্টাগুলোকে এ অঞ্চলের ভাগ্য আর ইতিহাস পরিবর্তনকারী বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলেছেন, 'ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রতিরোধ সংগ্রাম নির্মূলের চেষ্টায় ৫০ হাজারেরও বেশি নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সত্ত্বেও পরাজিত হয়েছে, কিন্তু আরও বড় পরাজয় হল পশ্চিমা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিবিদের কলঙ্কিত হওয়া। অনিষ্টতা ও দুর্বৃত্ততার অশুভ শক্তিগুলোর মোকাবেলায় প্রতিরোধ ফ্রন্টের লড়াইয়ে এই শেষোক্ত ফ্রন্টই বিজয়ী হবে'। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ওই ভাষণে তিনটি মৌলিক দিকের উল্লেখ রয়েছে যে বিষয়ে অসচেতন থাকা ঠিক হবে না। এ তিনটি বিষয় হল:
প্রথমত ইহুদিবাদী ইসরাইল কেবল যুদ্ধের ময়দানে ও সামরিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরাজয়ের শিকার হয়নি, গাজা পুনর্দখল, হামাসকে নির্মূল করা ও ইহুদিবাদী বন্দিদের মুক্ত করার মত দিকগুলোতে ব্যর্থ হওয়া ছাড়াও তার বড় পরাজয় হল ইহুদিবাদী শাসক গোষ্ঠীর নোংরা চেহারা সবার সামনে স্পষ্ট হওয়া যে চেহারার নোংরা দিকগুলো এতকাল তথা বহু বছর ধরে গণমাধ্যমের নানা কসরত দিয়ে কথিত 'অসহায়ত্বের' মুখোশের আড়ালে ঢেকে রাখা হয়েছিল।
এ যুদ্ধের প্রভাব কেবল সামরিক, রসদ-পত্রের ক্ষেত্রে ও যুদ্ধ-ক্ষেত্রে সীমিত থাকবে না। ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার পশ্চিমা সহযোগীদের সম্মিলিত এ পরাজয়ের যুদ্ধ বহির্ভূত নানা দিক ও ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা ছাড়া গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী ভবিষ্যতকেও বোঝা যাবে না। কিন্তু পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা ও গণমাধ্যমগুলো এই ব্যাপক ও সম্মিলিত পরাজয়ের বিষয়টিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করছে মরিয়া হয়ে ঠিক এইসব বিষয়গুলোকে ঢেকে রাখার জন্যই।
দ্বিতীয় দিকটি হল এ যুদ্ধে পাশ্চাত্যের আরও বড় পরাজয় ঘটেছে তথা পশ্চিমাদের কথিত সভ্যতা, বিশ্ব-ব্যবস্থা, নব্য-উপনিবেশিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় চিন্তা-চেতনা –ইত্যাদিও বিশ্ব-জনমতের কাছে হয়েছে কলঙ্কিত। আর এটি সম্ভব হয়েছে গত ১৩ মাসের সম্মিলিত বা হাইব্রিড প্রতিরোধ সংগ্রামের কারণে। এই সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন সত্যের পক্ষ অবলম্বনকারী বিশ্বের নানা অঞ্চলের জনগণ ও বিশ্ব-জনমত। শত্রুরা যে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক যুদ্ধ তথা হাইব্রিড যুদ্ধ জোরদার করেছিল সত্যের পক্ষের বিরুদ্ধে তার মোকাবেলায় পাল্টা হাইব্রিড যুদ্ধের ব্যাপারে মূলত সচেতন ছিল না। তারা এখন যুদ্ধের ময়দান ছাড়াও চিন্তাগত ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংলাপ আর সভ্যতার ময়দানেও পরাজয়ের বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
পার্সটুডে- পশ্চিমা ব্যবস্থা, যা একটি "আদর্শ পন্থা" বা জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বের মানুষের মনে অঙ্কিত হওয়ার কথা ছিল, তা এখন একটি "মূল্যবোধ-বিরোধী" বিষয় হয়ে উঠেছে এবং পরবর্তীকালে "পশ্চিমা ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের" অপরিহার্যতা বিশ্বের অনেক অংশে একটি "বিশ্বাস" হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিমা সরকারগুলো ও অস্ত্র কোম্পানিগুলো গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের বিরতিহীন গণহত্যা বা জাতিগত শুদ্ধি অভিযানে মন্ত্রমুগ্ধের মত এতটা একাত্ম হয়ে গেছে যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পশ্চিমা-বিশ্ব-ব্যবস্থা বিরোধী নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা জেগে ওঠার বিষয়টি টের পায়নি। সন্ত্রাসবাদ এবং বর্বরতার প্রতীক হিসেবে ইসরাইল ও তার সহযোগীদের যে বদনাম হয়েছে তা উপলব্ধি করে এর ক্ষতিপূরণ করার সময়ও পার হয়ে গেছে তাদের জন্য।
তৃতীয় দিকটি হল গাজা যুদ্ধের প্রতিরোধ অক্ষের তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব। বিশ্বের নানা অঞ্চলে এখন প্রতিরোধের ধারণা জনপ্রিয় হবে এবং এরই আওতায় অ-পশ্চিমায়নের ও ইহুদিবাদ-বিরোধী ধারণাও জোরদার হবে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ-সংগ্রামের চেতনা জোরদারের পাশাপাশি। আর এরই ধারবাহিকতায় সেইসব মিথ্যাচার ও মেকি বিশ্বাসগুলোও ধ্বংস হবে যেগুলোর ভিত্তিতে পশ্চিমা আধিপত্যবাদ টিকে আছে।
বর্তমানে শত্রুরা এই নজিরবিহীন দৃশ্যপট ও সমীকরণের কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। গত তেরো মাসের ঘটনাবলীতে যেসব বিশ্বাস ও চিন্তা জোরদার হয়েছে পাশ্চাত্যে সেসব প্রতিরোধ অক্ষের মহা-আঘাতেরই ফসল যে আঘাতগুলো পড়েছে পশ্চিমা-ইহুদিবাদী অক্ষের ওপর এবং এতে ওই অক্ষ মরণ-দশার মুখোমুখি। আর এই বিশাল সাফল্য ধরে রাখা ও নতুন যুগে এর কল্যাণ লাভের জন্য বিশ্বের সব অঞ্চলের প্রত্যেক মুক্তিকামী মানুষের দায়িত্ব রয়েছে। আর এই মূল্যবোধ ও প্রেরণা ধরে রাখার জন্য সক্রিয় থাকাটা শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ, শহীদ সাইয়্যেদ হাশেম সাফিউদ্দিন, শহীদ ইসমাইল হানিয়া ও শহীদ ইয়াহিয়া সিনাওয়ারের মত মহান ব্যক্তিত্বদের আত্মত্যাগ ও সাধনার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। #