‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : Parstoday
রবিবার

১ ডিসেম্বর ২০২৪

৬:২৯:২৪ PM
1510045

ইসরাইলকে জার্মানি কেন নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে?

গাজায় চলমান ইসরাইলি বর্বরোচিত আগ্রাসনের পক্ষে জার্মান সরকারের সমর্থন অনেককেই বিস্মিত করেছে। ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর দেশটির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছিলেন,‘এ মুহূর্তে জার্মানবাসীর একটাই পথ। আমরা ইসরাইলের পাশে আছি। ইসরাইলের নিরাপত্তা জার্মান রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত– এর মধ্য দিয়ে মূলত আমরা সে কথাই তুলে ধরি।’ জার্মান সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যকাররা আন্তর্জাতিক আদালত-আইসিজে ইসরাইরের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলাটিকে ‘স্পষ্টত একতরফা’ ঘোষণা করে একে অবৈধ প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরাইলের ভিতরে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের আল আকসা তুফান অভিযানের পর থেকে পাঁচ মাসে গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের সমালোচনাকে বন্ধ করার জন্য জার্মানি হলোকাস্টকে কীভাবে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে বিশ্ব তা দেখেছে। এই সংকটে জার্মান সরকারের আচরণ কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আলাদা ছিল না: উভয় দেশই ইসরাইলি শাসক গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র পাঠিয়েছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরাইলকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে, জার্মানি আরও এগিয়ে গেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণাকারী প্রতিবাদকারী শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের দমনে আরও আক্রমনাত্মকভাবে কাজ করেছে।

জার্মানি হচ্ছে সেই দেশ যেটির ওপর কথিত হলোকাস্টের প্রেতাত্মা ভর করে রয়েছে। নিজের নামের পাশ থেকে সেই কলঙ্ক মুছে ফেলার জন্য দেশটি শুরু থেকে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও এটিকে টিকিয়ে রাখার কাজে সাহায্য করেছে। সেইসঙ্গে গত বছরের অক্টোবরে ইহুদিবাদী ইসরাইল গাজায় আগ্রাসন চালানোর পর থেকেই ওই হামলাকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে জার্মানি।

জার্মানিতে হলোকাস্ট স্মরণ সংস্কৃতির গঠন এবং বিবর্তনের প্রক্রিয়ার বিষয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই জার্মানিকে একটি নেতৃস্থানীয় দেশ হিসাবে দেখেন যে দেশটিতে হলোকাস্ট স্মরণের এই সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে যা ইসরায়েলের জন্য নিঃশর্ত সমর্থনের দিকে পরিচালিত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়েও জটিল। ১৯৮০ সাল থেকে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানির রাজনৈতিক কাঠামোতে হলোকাস্ট স্মরণের এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এই পরিবর্তনগুলোর জন্য বেশিরভাগ দায়ী অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের উপর যিনি গত দুই দশক ধরে জার্মান রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছেন। কিন্তু এটি লক্ষ করা উচিত যে এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো জার্মানির বাম এবং আমেরিকা ও ইসরাইলের ডানপন্থীদের মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত জোট তৈরি করেছিল। আজ, জার্মান জোট সরকার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, গ্রিনস এবং ফ্রি ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে গঠিত। নেইম্যানের মতে ইসরাইল সম্পর্কে এই সরকারের অবস্থান "মার্কিন-ইসরাইল জনসংযোগ কমিটি বা আইপেকের অবস্থানের চেয়ে বেশি রক্ষণশীল এবং সহায়ক।"

২০০৫ সালে যখন লাল-সবুজ সরকারের অবসান ঘটে যখন মার্কেল জার্মানির চ্যান্সেলর হন এবং ১৬ বছর ধরে এই পদে অধিষ্ঠিত হন। ২০০৮ সালে ইসরাইলের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দেওয়ার সময় যেটি জার্মান চ্যান্সেলরের প্রথম বক্তৃতা ছিল মার্কেল জোর দিয়েছিলেন যে তার সমস্ত পূর্বসূরিরা ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য জার্মানির বিশেষ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে "এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমার দেশের জাতীয় স্বার্থের অংশ।"

২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ইসরাইলে জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডলফ ড্রেসার দ্বারা মার্কেলের অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। ড্রেসার ২০০৫ সালে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন যে ইসরাইলের নিরাপত্তা আমাদের জাতীয় স্বার্থের অংশ।

যদিও শব্দটি মূলত জোশকা ফিশারের কাছ থেকে ধার করা হয়েছিল মার্কেলের উপদেষ্টারা এটিকে তার "খ্রিস্টান গণতান্ত্রিক বক্তৃতা শৈলীর" চেয়ে বেশি উপযুক্ত বলে মনে করেছেন। স্পিগেল রিপোর্ট অনুযায়ী মার্কেলের এই পদক্ষেপটি কোনো বিকল্প নেই নীতি হিসাবে পরিচিত ছিল যেটি কার্যত গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার বৃত্ত থেকে ইসরাইলের প্রতি জার্মানির নীতিকে সরিয়ে দেয় এবং ঐতিহাসিক জার্গেন জিমারারের মতে এই নীতিটিকে "নো-ননসেন্স" নীতিতে পরিণত করে।

মার্কেল এক্ষেত্রে সফল ছিলেন। জার্মানির প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে একমত যে ইসরাইলের প্রতি দায়িত্ব দেশের জাতীয় স্বার্থের অন্যতম নীতি। ২০২১ সালে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, গ্রিনস এবং ফ্রি ডেমোক্র্যাটদের সমন্বয়ে গঠিত নতুন জোট সরকার একটি চুক্তি প্রকাশ করেছে যাতে বিস্ময়করভাবে এই ধারাটি অন্তর্ভুক্ত ছিল যে ইসরাইলের নিরাপত্তাই আমাদের জাতীয় স্বার্থ।

আল-আকসা তুফান অভিযান শুরু হওয়ার পর গাজা যুদ্ধের ব্যাপারে জার্মানির মানবতাবিরোধী সমর্থন বিশ্বব্যাপী বার্লিনের গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়েও কমিয়ে দিয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর আল-আকসা তুফান অভিযান শুরু হওয়ার পাঁচ দিন পর জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎস এক বক্তৃতায় গাজা যুদ্ধের ব্যাপারে তার দেশের নীতি সুস্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে জার্মানি শুধুমাত্র ইসরাইলের পাশে থাকতে চায়।”

চ্যান্সেলরের ওই ঘোষণার পর জার্মানি ইসরাইলের কাছে নিজের অস্ত্র রপ্তানি প্রায় ১০ গুণ বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর প্রয়োগ করার জন্য আমেরিকার পর ইসরাইলকে সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে জার্মানি।

ইসরাইলের প্রতি জার্মানির এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আরব দেশগুলোর জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। উত্তর আফ্রিকার আরব দেশ তিউনিশিয়ায় জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা শিশু হত্যাকারী ইসরাইলের প্রতি জার্মানির অকুণ্ঠ সমর্থনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। গত বছরের অক্টোবরে তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিসে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার প্রোগল যে বক্তব্য দেন তার বিরুদ্ধে তিউনিশিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

ওই অনুষ্ঠানে তিউনিশিয়ার শিক্ষামন্ত্রী ইসরাইলি আগ্রাসনের শিকার গাজাবাসীর প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। এরপর জার্মান রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন।

ওই ঘটনা তিউনিশিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে জার্মান দূতাবাসের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় এবং বিক্ষোভকারীরা জার্মান রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবি জানান।

ইসরাইলের প্রতি জার্মানির সমর্থনের কারণে পশ্চিম এশিয়ায় তৎপর জার্মানির বহু প্রতিষ্ঠান স্থানীয় জনগণের রোষাণলে পড়েছে।

মার্কেল অফিস ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে তার পররাষ্ট্র নীতির উত্তরাধিকারের সমালোচনা বেড়েছে বিশেষ করে চীন এবং রাশিয়ার তুলনায় নিরাপত্তার চেয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু ৭ই অক্টোবরের পরের ঘটনাগুলো দেখায় যে ইসরাইলের প্রতি জার্মানির পররাষ্ট্রনীতিতে মার্কেলের পূর্বসরীরাও ধ্বংসাত্মকভাবে কাজ করেছে। ২০০৯ ইসরাইলি পার্লামেন্টে মার্কেলের বক্তৃতার এক বছর পরে নেতানিয়াহু দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন এবং তারপর থেকে ইসরাইল ক্রমবর্ধমানভাবে চরম ডানদিকে ঝুঁকেছে। এখন জার্মানি ইসরাইলের সমালোচনা করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক এমনকি ইসরাইল তাদের ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ এবং তাদের উপর বোমাবর্ষণ করা অব্যাহত রাখলেও।#