১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ - ১৭:১২
কঠিন পরীক্ষায় সিরিয়া: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচির বিশ্লেষণ

পার্সটুডে-ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাকচি লেবাননের সংবাদপত্র আল-আখবারে লেখা এক নিবন্ধে সিরিয়া পরিস্থিতি এবং এই দেশটিকে বাঁচানোর উপায় বিশ্লেষণ করেছেন।

সিরিয়া ও ফিলিস্তিন পরিস্থিতি বিবেচনায় পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে মুসলিম বিশ্ব ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণ বহু শতাব্দী ধরে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ইহুদি-খ্রিস্টান সংকটের ফলে বিগত কয়েক দশক ধরে মুসলিম বিশ্ব তাদের সার্বভৌম অধিকারের ব্যাপারে অসচেতনতার কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে।

একজন কূটনীতিক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের বছরগুলিতে, "ফিলিস্তিন সংকট" সর্বদা আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। আলোচনার টেবিলে আমি সবসময় ইউরোপীয় সহকর্মীদের যুক্তির মুখোমুখি হয়েছি। তাদের ভাষ্য হলো 'জার্মান জনগণ ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসি শাসনের নৃশংসতার জন্য নিজেদেরকে অসম্মানিত এবং দায়ী বলে মনে করে'। তাদের এ বক্তব্যটি যথার্থ; কেননা ইউরোপীয় ইতিহাসের সেই অন্ধকার যুগের শাসকদের নৃশংস আচরণ তৎকালীন ইউরোপীয় মহাদেশের মানুষের দেহমনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের শরীরেও বহু ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। আমার দেশ ইরান এবং আমার দেশের জনগণ নিরপেক্ষ থাকা সত্ত্বেও সেই বিশ্ব যুদ্ধের কারণে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল।

কূটনৈতিক আলোচনায় যখন প্রতিপক্ষ তাদের লজ্জার কথা বলেছিল এবং এ বিষয়ে তাদের দায় স্বীকার করেছিল, তখন আমার মনে একটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছিল যে প্রশ্নের সাথে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সেটি হলো: ইসরাইলি ন্যাক্কারজনক অপরাধের জন্য কে দায়ী? যে অবৈধ দখলদার ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে আছে এবং সর্বদা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি যথারীতি লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, দখলদার ইসরাইলের প্রতিবেশীদের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বকে আক্রমণ করে যাচ্ছে এবং অব্যাহতভাবে জনগণের জন্য অনেক বিধিনিষেধ সৃষ্টি করেছে এমনকি মানবিক ত্রাণ-সাহায্য পাঠানোর পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নৃশংসভাবে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে! এই অপরাধের সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে গত ১৪অক্টোবর২০২৪-এর শোহাদায়ে আল-আকসা হাসপাতালের হলোকাস্টের কথা উল্লেখ করা যায়। গাজা শরণার্থী শিবিরে চালানো ওই গণহত্যাকে নাৎসি গণহত্যার আধুনিক সংস্করণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাদের নির্লজ্জ বর্বরতার উদাহরণের জন্য এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং ইসরাইলের বর্বর অপরাধের সম্প্রসারণ এবং সিরিয়ায় তার বিস্তারের ঘটনা আমার আগের প্রশ্নের সঙ্গে নতুন আরেকটি প্রশ্ন যোগ করেছে। প্রশ্নটি হলো: এমন একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ যে দেশটির অভ্যন্তরে এমনিতেই কঠিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে, একটি সরকারের পতনের পর আরেকটি সরকারের জন্ম হতে যাচ্ছে, সে দেশের ভূখণ্ডে ইসরাইলি আগ্রাসনের জন্য কে দায়ী? দুঃখ প্রকাশ করা এবং উদ্বেগ জানানো সবচেয়ে সহজ শব্দ এবং কখনও কখনও সবচেয়ে অর্থহীন শব্দ। যারা 'পশ্চিম এশিয়ার জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য দায়ী' তাদের দেশের সাহিত্যে এইসব অর্থহীন শব্দ ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।

আমরা কল্পনা করতেই পারি-একটি দেশের পতাকার রঙ পরিবর্তনের সাথে সাথে সেদেশের সমাজের প্রত্যাশা এবং সামাজিক আদর্শও পরিবর্তিত হবে। সিরিয়ার জনগণ সেই সাহসী মানুষ যারা ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের যুদ্ধে প্রতিরোধের বীরত্ব গাথা তৈরি করেছিল। ফিলিস্তিনের স্বার্থ রক্ষায় সিরিয়ার জনগণের একটা স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এ কারণে মাদ্রিদ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রাক্তন আরব-ভিত্তিক বাথবাদী শাসকদের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও, প্রতিরোধ ফ্রন্ট থেকে সিরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার শত্রুদের আশায় গুড়েবালি হয়েছিল।

সিরিয়া আজ কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে। আল-কায়েদা এবং আইএসআইএস-এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির আন্দোলনের কারণে সৃষ্ট হুমকি এই অঞ্চলের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে সন্ত্রাসীরা সিরিয়াকে নিজেদের জন্য নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত করবে। অপরদিকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের আগ্রাসন এবং সামরিক হস্তক্ষেপের পাশাপাশি আমেরিকা ও তাদের আঞ্চলিক মিত্ররা বাইরে থেকে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তারা অপূরণীয় কৌশলগত ভুলের শিকার হয়েছে যা লুকানোর অবকাশ নেই। এই আগ্রাসন ও হস্তক্ষেপের সুস্পষ্ট লক্ষ্য হলো সিরিয়ার সামাজিক ভিত্তি, বৈজ্ঞানিক সম্পদ, অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং প্রতিরক্ষা শক্তিকে ধ্বংস করা। সিরিয়ায় বিদেশী সেনাদের আক্রমণের ফলে সৃষ্ট আঘাত সত্ত্বেও এটা স্পষ্ট যে সেদেশের আশেপাশে সিরিয়ার জনগণের বহু লোক রয়েছে তারা খালি হাতে তবু প্রশংসনীয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ করে এসেছে। জাবালিয়ার ছোট শিবিরে দুই মাস ধরে ইহুদিবাদী স্থল ও বিমানবাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে তারা বীর-বিক্রমে লড়েছে।

সিরিয়ার বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে তাদের স্বাধীনতার পতাকাকে অক্ষুণ্ন রাখা এবং সিরিয় জাতির গৌরব ও মর্যাদাকে সম্মান করা, পতাকাকে উড্ডীন রাখা। অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ভূমির সন্তানদের মধ্যে সহাবস্থানের সংহতি ও চেতনা বজায় রাখা। এই দেশের ভবিষ্যৎ ভাগ্য সকল ব্যক্তি এবং শ্রেণীর জনগণের দ্বারা। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সিরিয়ার জনগণের ভোটকে সম্মান করা এবং সমাজের সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এটা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২২৫৪ নম্বর রেজোলিউশনের কাঠামোর ভিত্তিতে গৃহীত ইরানের পররাষ্ট্র নীতি।#