৩০ জুন ২০২৫ - ১২:০৮
Source: Parstoday
পশ্চিমা বিশ্বে দ্বিচারিতা—ওপেনহাইমার ‘উদ্ধারকর্তা’ আর ইরানি বিজ্ঞানীরা ‘হুমকি’

পার্স টুডে: ২০২৩ সালে ক্রিস্টোফার নোলানের তৈরি বায়োপিক ‘ওপেনহাইমার’ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার আয় করে এবং এটিতে ‘পারমাণবিক বোমার জনক’ জে. রবার্ট ওপেনহাইমারকে একজন জটিল, ট্র্যাজিক এবং নায়কতুল্য চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ ২০২৫ সালে ইসরাইল আগের বছরের মতোই ইরানের একাধিক পরমাণু বিজ্ঞানীকে—যাঁরা সামরিক নয়, বরং শান্তিপূর্ণ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন—টার্গেট করে হত্যা করে।

বিশ্বের মুক্তির জন্য একটি ‘বড় আবিষ্কার’

ওপেনহাইমারকে ‘নায়ক’ হিসেবে তুলে ধরার পেছনে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি ও এর তথাকথিত নৈতিক তাৎপর্য। পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুধু যুদ্ধ নয়, বরং এক নিরঙ্কুশ দানবীয় শত্রুর বিরুদ্ধে ‘ভালো যুদ্ধ’। এই ব্যাখা ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’-এর নৈতিক ও যৌক্তিক ভিত্তি গড়ে দেয়। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভয় ছিল—হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসি জার্মানি যেন আগে পারমাণবিক বোমা না বানিয়ে ফেলে।

যারা ওপেনহাইমার চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন—বোমা আবিষ্কারের পর নিজেই একধরনের অনুশোচনায় ভুগতেন ওপেনহাইমার। নিজেকে ‘বিশ্ব-বিধ্বংসী’ হিসেবে দেখার মানসিক যন্ত্রণায় তিনি কষ্ট পেতেন। তবুও তিনি কখনোই ‘খলনায়ক’ হিসেবে দেখানো হয়নি; বরং তাঁকে এক ধরণের ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে দেখা হয়েছে, যিনি দেশপ্রেম ও দূরদর্শী বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এই ধরনের বয়ানে ‘সাফল্য’ এতটাই উজ্জ্বল করে তুলে ধরা হয় যে, সৃষ্ট বোমার ভয়াবহতা, এমনকি নির্মাতার অনুশোচনাও যেন ম্লান হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালে তাঁর নিরাপত্তা ছাড়পত্র পুনর্মূল্যায়নের সময় তাঁকে এই যুক্তিতে সম্মান জানানো হয়—তিনি ছিলেন সেই সময়ের উপযুক্ত এক প্রতিভা, যিনি দেশের প্রয়োজনে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।

শব্দের মাধ্যমে নিরাপত্তা নির্মাণ

শুধু কাউকে ‘হুমকি’ হিসেবে চিত্রিত করলেই তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, সামরিক হামলা বা গুপ্তহত্যার পথ খুলে যায়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ঠিক এইভাবেই তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল—একে একটি নিরীহ কারিগরি বিষয় নয়, বরং অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে। বারবার এই দুই দেশ ইরানকে ‘অবিশ্বাসযোগ্য’, ‘বিচ্ছিন্ন’ ও ‘আঞ্চলিক হুমকি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এই বয়ান অনুসারে, যেখানে ওপেনহাইমার একটি ঘোষিত যুদ্ধে যুক্ত ছিলেন, সেখানে ইরানের বিজ্ঞানীরা এক রহস্যময় ও বিতর্কিত পরিবেশে কাজ করেন। পশ্চিমা-ইসরাইলি চিত্রনাট্যে বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্র একত্রে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিত্রিত হওয়ায় তাঁদের হত্যাকেও ন্যায্য বলে উপস্থাপন করা হয়।

‘নায়ক’ আর ‘শত্রু’ তৈরির গণমাধ্যম কাঠামো

ওপেনহাইমার বনাম ইরানি বিজ্ঞানীদের পার্থক্য কেবল ঘটনাতেই নয়—গণমাধ্যমের কাঠামোতেও। গণমাধ্যম কেবল তথ্য সরবরাহ করে না, বরং বাস্তবতার নির্দিষ্ট অংশ তুলে ধরে নির্দিষ্ট বার্তা তৈরি করে। ওপেনহাইমারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দ যেমন—‘জাতীয় নিরাপত্তা’, ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই’, ‘বৈজ্ঞানিক অর্জন’, ‘নৈতিক দ্বিধা’।

অন্যদিকে, ইরানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দগুলো হলো—‘পারমাণবিক অস্ত্র’, ‘সন্ত্রাসের মদদদাতা’, ‘অস্তিত্বগত হুমকি’, ‘গোপন কর্মসূচি’। পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইরানের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা ‘প্রচার’ বা ‘বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার কৌশল’ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

দর্শকের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ

ওপেনহাইমারকে পশ্চিমা শ্রোতা দেখেন জাতীয় ইতিহাসের অংশ হিসেবে—যেখানে তিনি ‘বিজয়ের প্রতীক’। এই ব্যাখ্যা সাংস্কৃতিকভাবে গৃহীত, যেখানে দর্শকরা সেই ব্যক্তিকে হিরো বানাতে প্রস্তুত, যে তাদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করেছে।

ইসরাইলি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ইরানি বিজ্ঞানীরা সরাসরি হুমকি। ফলে তাঁদের হত্যা ‘আত্মরক্ষামূলক’ পদক্ষেপ। কারণ, তারা বিশ্বাস করে—ইরান সত্যিই তাদের ধ্বংস করতে চায়।

অন্যদিকে, ইরানি বা তৃতীয় বিশ্বের দর্শকের চোখে এই দ্বিচারিতা হলো—পশ্চিমা  ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণার বহিঃপ্রকাশ। যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যারা পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করেছে, অথচ তারা অন্যদের ‘হুমকি’ বানায়। ইসরাইল নিজেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী, তবুও এনপিটি-তে স্বাক্ষর না করে ইরানকে অস্ত্র তৈরি করতে দিচ্ছে না। ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ডকে তারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে দেখে এবং নিহতদের শহীদ হিসেবে সম্মান জানায়।#

Your Comment

You are replying to: .
captcha