১৩ নভেম্বর ২০২৫ - ০২:১১
গাজায় বেসামরিক ফিলিস্তিনি হত্যা সম্পর্কে মুখ খুলল ইসরায়েলি সেনারা।

গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও আইনি সীমারেখার ভাঙন নিয়ে মুখ খুলেছে কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিটের কমান্ডার ড্যানিয়েল বলে, যদি আপনি লাগামছাড়া গুলি চালাতে চান, পারবেন। কেউ আটকাবে না। গাজায় এখন কোনও নিয়ম বা নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে কর্মকর্তাদের ইচ্ছামতো বেসামরিক মানুষ নিহত হচ্ছে।


তথ্যচিত্রে অংশ নেওয়া কিছু সেনা নাম প্রকাশ না করে সাক্ষাৎ দেয়, আবার কেউ খোলাখুলি কথা বলে। তারা সবাই বলেছে, বেসামরিক নাগরিকদের নিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আচরণবিধি কার্যত বিলুপ্ত হয়েছে।


তথ্যচিত্রে অংশগ্রহণকারী সেনারা ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অথচ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সবসময় এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারা আরও জানায়, মার্কিন-ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর খাদ্য বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে যাওয়া সাধারণ মানুষদের ওপরও বিনা উসকানিতে গুলি চালানো হয়েছে।

এলি নামে পরিচয় দেওয়া এক সেনা বলেন, জীবন-মৃত্যু নির্ধারণ করে কমান্ডারের বিবেক। কোনও নিয়ম বা প্রক্রিয়ার গুরুত্ব নেই। তার মতে, কারও হাঁটার গতি, অঙ্গভঙ্গি বা অবস্থানই এখন ‘সন্দেহের কারণ’।

আর্মার্ড কর্পস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ইয়োটাম ভিল্ক বলেন, আমাদের প্রশিক্ষণে শেখানো হতো যে, ‘মিনস, ইনটেন্ট অ্যান্ড অ্যাবিলিটি’। অর্থাৎ টার্গেটের হাতে অস্ত্র, উদ্দেশ্য ও সামর্থ্য থাকতে হবে। গাজায় এখন এর কিছুই নেই। শুধু সন্দেহই যথেষ্ট। ২০ থেকে ৪০ বছরের কোনও পুরুষ হলে গুলি করা হয়।

এলি জানায়, এক সিনিয়র কর্মকর্তা একবার ‘নিরাপদ এলাকা’র একটি ভবন ধ্বংসের নির্দেশ দেয়। সেখানে ছাদের ওপর একজন মানুষ কাপড় শুকাচ্ছিলেন। তার হাতে দূরবীন বা অস্ত্র ছিল না, সামরিক বাহিনী ছিল ৬০০-৭০০ মিটার দূরে। তবু ট্যাংক থেকে গোলা ছোড়া হয়, ভবন ধসে পড়ে, অনেক মানুষ মারা যায়।

দ্য গার্ডিয়ানের আগস্টের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইসরায়েলি সামরিক তথ্য অনুসারে গাজায় নিহতদের ৮৩ শতাংশই বেসামরিক, যা আধুনিক যুদ্ধে নজিরবিহীন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৬৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যদিও এক মাস আগে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।

লিখিত বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, আইডিএফ আইন ও নৈতিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। হামাসের বেসামরিক স্থাপনা ব্যবহারের জটিলতার মধ্যেও আমরা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

তথ্যচিত্রে অংশ নেওয়া কিছু সেনা জানায়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যে তারা প্রভাবিত হয়। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ তখন বলেছিল, এটা পুরো জাতির দায়িত্ব, বেসামরিক কেউ ‘জড়িত নয়’ এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

ট্যাংক কমান্ডার ড্যানিয়েল বলে, যখন বারবার শুনতে হয় যে গাজায় কোনও নিরপরাধ নেই, তখন একসময় তা বিশ্বাসে পরিণত হয়।

ব্রিগেডের এক কর্মকর্তা মেজর নেটা ক্যাসপিন বলে, আমাদের এক রাব্বি আধা ঘণ্টা ধরে বলেছিল যে, ৭ অক্টোবরের মতো প্রতিশোধ নিতে হবে, বেসামরিকদের বিরুদ্ধেও।

চরমপন্থি ধর্মযাজক রাব্বি আভ্রাহাম জারবিভ তথ্যচিত্রে বলেছে, গাজার প্রতিটি জায়গাই সন্ত্রাসী অবকাঠামো। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষে বুলডোজার চালিয়ে তিনি নিজেই ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নিয়েছে।

সেনারা আরও স্বীকার করে যে, ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটিকে তারা ‘মশা প্রোটোকল’ নামে অভিহিত করে। ড্যানিয়েল বলে, মানবঢালকে টানেলে পাঠানো হয়, তার পোশাকে লাগানো আইফোন দিয়ে জিপিএস তথ্য পাঠানো হয়। এই কৌশল দ্রুত পুরো বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে।

তথ্যচিত্রে জিএইচএফের এক ঠিকাদার স্যাম বলে, সে দেখেছে, সেনারা ত্রাণের জন্য দৌড়ে যাওয়া নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করেছে। এক জায়গায় সে দেখেছে, দুই যুবক দৌড়াচ্ছিল, দুই সৈনিক হাঁটু গেড়ে গুলি ছোড়ে, আর তাদের মাথার খুলি ফেটে যায়।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য বিতরণকেন্দ্রের আশপাশে কমপক্ষে ৯৪৪ জন ফিলিস্তিনি বেসামরিক নিহত হয়েছেন। আইডিএফ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সচেষ্ট।

তথ্যচিত্রে সেনাদের মানসিক চাপও উঠে এসেছে। ড্যানিয়েল বলে, আমি মনে করি, তারা আমার ইসরায়েলি পরিচয়ের সব গর্ব মুছে দিয়েছে। শুধু লজ্জা রয়ে গেছে।

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha