‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ParsToday
মঙ্গলবার

১৪ জানুয়ারী ২০২০

৭:১৩:২৪ AM
1002203

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসি'র কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানি শহীদ হওয়ার পর বোঝা গেছে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি কতখানি জনপ্রিয় ছিলেন। তার জানাজা নামাজ ও শোক র‍্যালিতে লক্ষ কোটি মানুষের উপস্থিতি সারা বিশ্বকে হতবাক করেছে। এতো মানুষের সমাগম বিশ্বে নজিরবিহীন।

(ABNA24.com) "কাসেম সোলাইমানি ইরানে হাজ কাসেম নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৯৭ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী হাজি কাসেমকে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী'র কুদস ব্রিগেডের প্রধানের দায়িত্বে নিয়োগ দেন। ফলে ৪১তম সারাল্লাহ ডিভিশনের অন্য সেনা সদস্যরা মর্মাহত হন এই ভেবে যে এখন থেকে আর হাজি কাসেমকে কাছে পাওয়া যাবে না। কারণ হাজি কাসেম ছিলেন এই ডিভিশনের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তবে কুদসের প্রধান হলেও তিনি এই ভিডিশনের সদস্যদেরকে কখনো ভুলে যাননি।" এ কথাগুলো বলেছেন, ৪১তম সারাল্লাহ ডিভিশনের অন্যতম যোদ্ধা হাজ কামাল দুস্তি। কেরমানের এই খ্যাতনামা যোদ্ধা হাজ কামাল দুস্তি ছিলেন শহীদ সোলাইমানির খুব কাছের মানুষ। এভাবে সোলাইমানের এক সময়ে আরো অনেক পুরানো সহযোগী নানাভাবে তাদের স্মৃতি চারণ করছেন। যেন সোলাইমানির শাহাদাতের ঘটনায় বিপ্লব ও পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের দিনগুলো আবারো ফিরে এসেছে। সবার শরীরে রক্ত টগবগ করছে। এ যেন ইসলামের ধমনীগুলোতে ফের জীবনের সঞ্চার এবং ইসলামের প্রতিরক্ষায় শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সবাই।

হাজি কাসেম বছরে মাত্র দুইবার অর্থাৎ হযরত ফাতেমা জাহরা (সা.)এর ওফাত বার্ষিকী  এবং রমজান মাসে নিজ বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতেন। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময় ৪১তম সারাল্লাহ ডিভিশনের ৪২০ ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডার মোহাম্মদ শারিফ শাহ মোরাদি ছিলেন হাজ কাসেমের অতী ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। শুক্রবার মার্কিন ড্রোন হামলায় জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাতাদের ঘটনা শোনামাত্রই তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, "গেল রমজান মাসে সোলাইমানির সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল। তখন তিনি নীতি নৈতিকতার বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন এবং সেইসঙ্গে সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধের অনেক অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা বলেন। আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময়কার মতোই আমরা একসঙ্গে বসে গল্প করেছি। বছরে অন্তত দুইবার তার সঙ্গে দেখা হত। কিন্তু এখন  থেকে তাকে আর দেখতে পাব না এবং মনে হচ্ছে আমি এতিম হয়ে গেলাম।"

সাধারণ মানুষ জেনারেল সোলাইমানিকে সামরিক অঙ্গনে ও যুদ্ধক্ষেত্রে একজন ত্যাগী ও সাহসী মানুষ হিসেবেই চেনে। কিন্তু তার বড় মাপের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানতো। তিনি শহীদদের স্মৃতিকে চিরঞ্জীব ও অম্লান করে রাখার জন্য অনেক কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্য সবার চেয়ে অগ্রগামী এবং বলা যায় ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অগ্রনায়ক। তিনি ছিলেন শহীদের পরিবার ও সন্তানদের আশ্রয়স্থল।

জেনারেল সোলাইমানির জীবন ছিল প্রেমাসক্ত। তিনি ভালবাসার প্রকৃত অর্থ বাতলে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভেঙেপড়া ও হতাশাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে নতুন করে প্রাণসঞ্চারকারী। এটা সবাই জানত যে কাসেম সোলাইমানি যখনই শহীদদের কোনো শোকানুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন সেখানকার নীরবতা ভেঙে যেত এবং শহীদের সন্তানেরা হৈ চৈ করে ছুটে এসে সোলাইমানির পাশে বসত। মনে হত বাচ্চারা যেন পিতার সাথে মোলাকাত করতে এসেছে।

তিনি বাচ্চাদেরকে এতোটাই আদর স্নেহ করতেন যে তার উপস্থিতিতে বাচ্চারা এক মুহূর্তের জন্যও স্থির হয়ে বসে থাকত না। এমনকি সোলাইমানিকে পেয়ে তারা বড়দের কথাও শুনতে চাইত না এবং আনন্দে দিশেহারা হয়ে যেত। এমনই একদিনে ঘটনা হচ্ছে, জেনারেল সোলাইমানি একবার শহীদদের পরিবারের একটি মজলিসের পেছনের দরজা দিয়ে আস্তে করে ভেতরে প্রবেশ করে নিঃশব্দে একটি চেয়ারে বসে পড়েন। এক পর্যায়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য সোলাইমানিকে আমন্ত্রণ জানানো হল। কিন্তু বাচ্চারা হঠাৎ তাকে পেয়ে ঘিরে ধরে কথা বলা শুরু করে, কেউ গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত। বাস্তবতা হচ্ছে শহীদ পরিবারের শোকানুষ্ঠানগুলোতে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কথাবার্তা হয় এবং একে অপরকে সহমর্মিতা জানায়।

শহীদ সোলাইমানির শোকানুষ্ঠানে শহীদ আনসারির স্ত্রী ফাতেমা জাফরি বলেছেন, আজ আমরা সকলে সমবেত হয়েছি এমন এক শোকার্ত পরিবারের মতো যাদের পিতা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা স্বজনহারা একে অপরের দুঃখ বেদনা ভালভাবে উপলব্ধি করছি।

ইসলামি সংস্কৃতিতে এতিমের প্রতি আদর-যত্ন ও দেখাশোনাকারীরা বেহেশতে যাবে। এতিমদের প্রতি জুলুম এবং তাদের সম্পদ ও অধিকার নষ্ট করার ফলে মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আল্লার গজব নেমে আসে। স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালবাসা মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে। বিশেষ করে এতিম শিশুদের প্রতি ভালবাসা তাদের জন্য জরুরি এবং তারাই সবচেয়ে বেশি হকদার। একমাত্র পিতামাতাই শিশুদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য অভিভাবক এবং তারাই পারে স্নেহ-মমতা দিয়ে শিশুদেরকে আগলে রাখতে। এ ধরনের আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত শিশুরা ভালবাসা পাওয়ার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে। এ কারণে শহীদ কাসেম সোলাইমানি শহীদ পরিবারের এতিম শিশুদেরকে খুব আদর করতেন, তাদের খোঁজ খবর নিতেন, কোলে নিতেন, নিজ হাতে তাদের মুখে খাবার তুলে খাওয়াতেন। তিনি তার হাসি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে শিশুদের মনকে খুশীতে ভরে দিতেন। এমনকি নামাজ পড়া অবস্থায় এক শহীদের ছোট্ট সন্তানের দেয়া গোলাপ ফুল গ্রহণ করেছিলেন। তিনি রাসুল(সা.)এর ওই হাদিস জানতেন যেখান রাসুল বলেছেন, "যখন একজন এতিম কান্নাকাটি করে তখন খোদার আরশ কেঁপে ওঠে। আল্লা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যেকেউ এতিমের কান্না থামাতে পারবে তার জন্য বেহেশত অবধারিত।"  

জেনারেল কাসেম সোলাইমানি শুধু যে ইরানের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তাই নয় একইসঙ্গে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের জনগণের মধ্যেও তিনি ঠাঁই করে নিয়েছিলেন এবং বহির্বিশ্বে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ কারণে তিনি শত্রুদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। শহীদী মর্যাদা লাভের জন্য কাসেম সোলাইমানি জিহাদের পথ বেছে নিয়েছিলেন। হযরত আলী যেমনটি বলেছেন, "বেহেশতের দরজাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জিহাদ ও শহীদী মর্যাদা।" জেনারেল সোলাইমানি যেমন ছিলেন অত্যন্ত নরম মনের মানুষ তেমনি যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ। তিনি লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক ও সিরিয়ায় আমেরিকা ও ইসরাইলের বহু ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হন। তিনি ইরাকে শিয়া মুসলমানদেরকে সংঘবদ্ধ করার পাশাপাশি দেশটির সুন্নি মুসলমান ও কুর্দিদের সহায়তায় এগিয়ে গিয়েছিলেন। তার কারণেই দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল ইরাক ।

ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস সন্ত্রাসীদের দমন করা ছিল জেনারেল সোলাইমানির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ও অবদান যেকারণে তিনি ছিলেন আইএস'র পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার  চক্ষুশূল। তিনি সবসময় যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন এবং কখনো সামরিক পোষক পরতেন না। কারণ তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা।

...........
340