‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ParsToday
রবিবার

১৯ জানুয়ারী ২০২০

১০:০০:০২ AM
1003606

জেনারেল সোলাইমানি: মৃত্যুতে যার প্রাপ্তির পূর্ণতা; শূন্যতা পূরণ হবে কি

ড. সোহেল আহম্মেদ: ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসির কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানির নানা বক্তব্যে বারবারই শহীদ হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। সোলাইমানির মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আলী রেজা বলেছেন, ‘বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হতো। বাবা কথায় কথায় বলতেন তিনি শহীদ হওয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু শাহাদাৎ তাকে ধরা দিচ্ছে না।'

(ABNA24.com) স্বামীর মৃত্যুর পর কাসেম সোলাইমানির স্ত্রী এক কবিতায় লিখেছেন, ‘সোলাইমানি শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অবশেষে তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে।'

কয়েক বছর আগে সিরিয়ার আলেপ্পোতে জঙ্গি-বিরোধী যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন ইরানের হোসেন মেহরাবি। তার মেয়ে যেইনাব মেহরাবি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বাড়িতে কাসেম সোলাইমানিকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। জেনারেল সোলাইমানিকে সামনে পেয়ে তাঁর হাতের আংটিটি চেয়ে বসেছিলাম। বলেছিলাম, চাচা আপনার আংটিতো বেশ সুন্দর। ওটা কি আমাকে দেবেন? আংটিটি তিনি ঠিকই দিয়েছিলেন, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। আংটিটি তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আংটি আমি দিচ্ছি, কিন্তু শর্ত হলো আমি যাতে শহীদ হতে পারি সেই দোয়া তোমাকে করতে হবে।

যেইনাব আংটিটি নেয়ার পর শর্তের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ কারণে আবার জেনারেল সোলাইমানির কাছে ফিরে গিয়ে বলেন, চাচা, শর্ত মেনে এই আংটি আমি নিতে পারব না। কারণ আপনার জন্য এ ধরণের দোয়া করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি চাই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার আগে আপনি এ পৃথিবী ছেড়ে কোথাও যাবেন না। জেনারেলের উত্তর ছিল, ‘মাগো আমি শহীদ হতে চাই। শাহাদাতই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা।’শাহাদাতই যে কাসেম সোলাইমানির জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল তা সম্ভবত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়িও জানতেন। এ কারণে গত মার্চে তিনি জেনারেল সোলাইমানির শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন। গত ৩ জানুয়ারি (২০২০) জেনারেল সোলাইমানির জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে। শহীদ হওয়ার মধ্যদিয়ে তার প্রাপ্তির পূর্ণতা ঘটেছে।

ইসলাম ধর্ম মতে, যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে প্রাণ হারান তারা শহীদ হিসেবে গণ্য হন। প্রকৃত শহীদ কারা তা নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা ও বিতর্ক আছে। তবে বিশ্বের প্রায় সব মাজহাবের আলেম‌ই মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান মসজিদুল আকসার প্রকাশ্য দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যারা প্রাণ হারাচ্ছেন তাদেরকে শহীদ বলে স্বীকৃতি দেন। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়িত ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের প্রধান নেতা ইসমাইল হানিয়া তেহরানে জেনারেল সোলাইমানির জানাযায় অংশ নিয়ে বলেছেন, 'আজীবন ফিলিস্তিনিদের জন্য কাজ করে গেছেন এই ইরানি জেনারেল।’কাসেম সোলাইমানিকে তিনি মসজিদুল আকসার শহীদ হিসেবে ঘোষণা করেন।

সোলাইমানির চমকে দেওয়া কিছু বৈশিষ্ট্য তাঁকে বর্তমান মর্যাদায় আসীন হতে সহায়তা করেছে। তাঁর এক স্মৃতিচারণ থেকে জেনেছি প্রায় অর্ধশতক আগে ১৩ বছর বয়সে বাবার সম্মান বাঁচাতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেন তিনি। তাঁর বাবা তৎকালীন রাজতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে প্রায় একশ' ডলার সমপরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অর্থ সময়মতো পরিশোধের সক্ষমতা বাবার ছিল না। তাই বাবার ঋণের বোঝা কমাতে চাচাতো ভাই আহমাদ সোলাইমানির সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করতে গ্রাম থেকে শহরে আসেন এবং একটানা ছয় মাসের বেশি কঠোর পরিশ্রমের পর টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পরবর্তীতে দু'জনই সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেন এবং এক পর্যায়ে চাচাতো ভাই শহীদ হন। দেশের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল হওয়ার পরও কাসেম সোলাইমানির মাঝে অহংকার ও ঔদ্ধত্যের ছাপ ছিল না। তিনি ছিলেন প্রচার-বিমুখ, অতি সাদাসিধা জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন বিশ্বের এক নম্বর জেনারেল। মার্কিন জার্নাল 'ফরেন পলিসি' গত বছর তাঁকে বিশ্বের সেরা সমরবিদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিপ্লব-উত্তর ইরানে সর্বোচ্চ জাতীয় পদক 'জুলফিকার' অর্জনকারী একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন সোলাইমানি। মৃত্যুর পর গোটা অঞ্চল বিশেষকরে ইরান ও ইরাকের মানুষ যেভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। ইরানের পাঁচটি শহরে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই পাঁচ শহরে তাকে বিদায় জানাতে আড়াই কোটি মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। তিনি ইহজগৎ জয় করে বীর বেশে পরজগতে প্রবেশ করেছেন।

কাসেম সোলাইমানি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ সমরবিদ ও ঝানু কূটনীতিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় সামরিক শক্তির মোকাবিলায় টিকে থাকতে হলে যে কেবল প্রচলিত যুদ্ধের কৌশলে কাজ হবে না তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তার বিচক্ষণতায় মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদ বিরোধী এক বিশাল প্রতিরোধ ফ্রন্ট গড়ে উঠেছে। ফিলিস্তিন ও লেবাননের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই এই ফ্রন্টের শক্তি জোরদার হচ্ছে। এই ফ্রন্টের একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন কাসেম সোলাইমানি। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজের অবদান পুরোপুরি সম্পন্ন করেছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ প্রতিরোধ ফ্রন্টের এই নির্মাতা পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চান সে ঘোষণা অনেক আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। এমন বিচক্ষণ সমরনায়ক নিজের যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি না করেই বিদায়ের সুর বাজাবেন তা হতে পারে না। এ কারণে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, তিনি যোগ্য নেতৃত্ব ও সমরবিদ তৈরি করেই পৃথিবী ছেড়েছেন। ইরানের আইআরজিসির সাবেক প্রধান ও জাতীয় নীতি নির্ধারণী কাউন্সিলের বর্তমান সচিব জেনারেল মোহসেন রেজায়ির বক্তব্যেও এই ইঙ্গিত রয়েছে। জেনারেল রেজায়ি জানিয়েছেন, কাসেম সোলাইমানি তার উত্তরসূরির নাম বলে গেছেন। কাসেম সোলাইমানির কথার ভিত্তিতেই তাঁর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইসমাইল কায়ানিকে এ পদে নিয়োগ দেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। ইসমাইল কায়ানি প্রায় ১২ বছর সোলাইমানির প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন কুদস ফোর্সের সেকেন্ড ইন কমান্ড। তারা দু'জন ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। ইসমাইল কায়ানি তার পূর্বসূরির মতো কূটনীতিতেও অত্যন্ত ঝানু।

ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধানকে দেশের বাইরে সামরিক দিক সামলানোর পাশাপাশি ক্ষেত্র বিশেষে কূটনীতিকের ভূমিকাও পালন করতে হয়। ২০১৭ সালে কাসেম সোলাইমানি ইরাক থেকে কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ইসরাইলি ষড়যন্ত্র বিনা বক্তপাতে নস্যাৎ করে দেন কূটনীতির মাধ্যমে। তিনি কুর্দি গোষ্ঠীগুলোর নিজেদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় যেমন ভূমিকা রেখেছেন তেমনি ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কুর্দিস্তানের বোঝাপড়ায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যেসব দেশে কুদস ফোর্সের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তৎপরতা রয়েছে সেসব দেশের প্রায় সব প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে জেনারেল সোলাইমানির অবিশ্বাস্য সখ্যতা ছিল। আফগানিস্তানের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি তিনি সেখানকার আরেক অন্যতম প্রধান শক্তি তালেবানের ওপর প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন। জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুর পর তালেবান যে শোকবার্তা দিয়েছে তা বিস্ময়কর। তারা আল্লাহর কাছে জেনারেল সোলাইমানির জন্য জান্নাত চেয়ে দোয়া করেছে। ইরানি কোনো ব্যক্তিত্বের জন্য তালেবানের এমন শোকবার্তা বিরল।

কাসেম সোলাইমানির জীবদ্দশাতেই ইসমাইল কায়ানি কূটনীতিতে তার দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। ২০০৯ সালে ইরানের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্যু করার মার্কিন ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায় ইসমাইল কায়ানির সহযোগিতায়। সে সময় আফগানিস্তানে ইরানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ফাদা হোসেন মালেকি। তিনি জানতে পারেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটের দুই প্রার্থী হামিদ কারজাই ও আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর দ্বন্দ্বকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে আমেরিকা সেখানে ক্যু করার ষড়যন্ত্র করেছে এবং মার্কিন প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে সেদেশ শাসনের ষড়যন্ত্র প্রায় চূড়ান্ত। এ অবস্থায় কাসেম সোলাইমানির সহযোগিতা চান ইরানি রাষ্ট্রদূত। সে সময় তিনি ইসমাইল কায়ানিকে আফগানিস্তানে পাঠান। ইরানের সাবেক রাষ্ট্রদূতের দাবি, ইসমাইল কায়ানির কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ দ্বিতীয় দফার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান এবং কারজাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে থেকে যান।

শুধু কুদস ফোর্সের নয়া প্রধান ইসমাইল কায়ানি নন, সোলাইমানির শূন্যতা পূরণের মতো আরও অনেক জেনারেল রয়েছেন ইরানে। ৮ জানুয়ারি (২০২০) ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি আইন আল-আসাদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করলে আইআরজিসি'র অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমির আলী হাজিযাদেহ'র মাঝেও সোলাইমানির ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সেদিন আইন আল-আসাদে মার্কিন বাহিনী কার্যত অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইরানের একটি ক্ষেপণাস্ত্রও ঠেকাতে পারেনি তারা। সেদিন ইরান রক্তপাত ঘটানোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে মূলত এই বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, তারা যেখানে ইচ্ছে সেখানে আঘাত হানার সক্ষমতা রাখে। হাজিযাদেহ নিজে সেই হামলা তদারকি করেন। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই চালান ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার। এর ফলে আকাশে থাকা মার্কিন সব ড্রোন ও জঙ্গি বিমান কয়েক মুহূর্তের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এতে হতবাক হয়ে যায় মার্কিন বাহিনী। এর ফলে পাল্টা সব পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকে।

বিপ্লব-উত্তর ইরানে শত্রুর হাতে রাষ্ট্রনায়ক বা সমরনায়ক নিহতের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ আলী রাজায়ি, প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ বহোনার, প্রধান বিচারপতি মোহাম্মাদ বেহেশতি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সমরবিদ মোস্তফা চামরান এবং ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম তাত্ত্বিক আয়াতুল্লাহ মোতাহারিও শত্রুদের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের বিদায়-যন্ত্রণাতেও কেঁদেছে গোটা ইরানি জাতি। তবে তারা থেমে থাকেনি, শূন্যতা পূরণ করে এগিয়ে গেছে। ইরানিদের মধ্যে যারা ধর্মের প্রতি খুবই অনুগত তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন- শহীদদের রক্তই আজও ইরানকে টিকিয়ে রেখেছে, নিরাপত্তা ও শক্তি দিচ্ছে। কাসেম সোলাইমানির রক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অপশক্তির পতন তরান্বিত করবে বলে তারা মনে করেন।

..........
340