‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : Jugantor
বৃহস্পতিবার

২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০

৩:১৭:৫০ AM
1013507

দাঙ্গাবাজদের ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ, দিল্লিতে ৩ দিনে নিহত ২৭

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ৩ দিনের সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান মোদির * সেনা মোতায়েন চান কেজরিওয়াল

আবনা ডেস্কঃ বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে সোমবার শুরু হওয়া সহিংসতায় ৭০ জন গুলিবিদ্ধসহ দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। হতাহতদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন।
বুধবার নগরীর চান্দবাগ এলাকায় সিএএ সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় চান্দবাগসহ অনেক এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দাঙ্গাকবলিত এলাকাগুলোয় পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি ‘ভয়ানক’ বর্ণনা করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল দাঙ্গাকবলিত এলাকাগুলোয় সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে, নীরবতা ভেঙে বুধবার দিল্লিবাসীকে শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। খবর আনন্দবাজার, এনডিটিভি, বিবিসি, রয়টার্স ও হিন্দুস্থান টাইমসের।
সিএএ সমর্থক ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় সোমবার থেকে উত্তর-পূর্ব দিল্লির কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় এবার সেখানে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে বুধবার দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন।
এলাকার সরকারি ও বেসরকারি স্কুলও বন্ধ রাখা হয়েছে। দিল্লিতে ৩ দিন ধরে নজিরবিহীন সংঘাতের পর দিল্লি পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য নগরীর দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোয় অবস্থান নিয়েছে। নগরীর দাঙ্গাকবলিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। কোথাও কোথাও অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এসেছে। বুধবার সকালে এলাকাগুলো যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দেখাচ্ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলা হলেও সেখান থেকে একের পর এক মৃত্যুর খবর আসছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২৪ ঘণ্টায় তিনটি বৈঠক করেছেন। কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিকে, দিল্লির হাইকোর্ট এক আদেশে সহিংসতায় আহতদের জরুরি চিকিৎসা ও জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন।
মসজিদে অগ্নিসংযোগ, মিনারে হনুমান পতাকা : দিল্লির অশোক নগর এলাকায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। অগ্নিসংযোগের পর উন্মত্ত জনতা ‘জয় শ্রী রাম’, ‘হিন্দুস্তান হিন্দুদের’ স্লোগান দিয়ে মহড়া দেয়। এ সময় মসজিদের মিনারে একটি হনুমান পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়- উন্মত্তজনতার একজনের হাতে একটি ভারতীয় পতাকা নিয়ে মসজিদের মিনারে আরোহণ করতে। মিনারের একাংশ ভাঙতে চেষ্টা করেন ওই ব্যক্তি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হননি। মসজিদের ভবনসংশ্লিষ্ট ও আশপাশের দোকানগুলোতে লুটপাট চালানো হয়।
স্থানীয়দের দাবি, লুটপাটকারীরা ওই এলাকার বাসিন্দা নন। এলাকাটিতে বেশিরভাগই হিন্দু। তবে কয়েকটি মুসলিম পরিবার রয়েছে। ঘটনাস্থলে দমকল বাহিনীর কর্মীদের দেখা গেলেও পুলিশের উপস্থিতি ছিল না। স্থানীয়রা বলেছেন, পুলিশ ওই এলাকা থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের সরিয়ে দিয়েছে।
নীরবতা ভাঙলেন মোদি, দিল্লিতে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আর্জি : ৩ দিন ধরে জ্বলছে দিল্লি। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। এ নিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে তোলপাড় শুরু হলেও নীরব ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
অবশেষে বুধবার নীরবতা ভাঙলেন তিনি। দিল্লিবাসীকে শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এ দিন টুইটারে তিনি লেখেন, ‘শান্তি ও সম্প্রীতি আমাদের সংস্কৃতির মূল কথা। দিল্লির ভাই-বোনদের কাছে অনুরোধ, সর্বদা শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখুন। যত দ্রুত সম্ভব দিল্লিতে শান্তি এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসাটা জরুরি।’ টুইটারে তিনি আরও লেখেন, ‘দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছি আমি। অতি দ্রুত যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় এবং শান্তি ফিরে আসে সেজন্য পুলিশ এবং অন্য সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কাজ করছে।’
সেনা মোতায়েন চাইছেন কেজরিওয়াল : হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডবে সৃষ্ট সহিংসতা সামাল দিতে দিল্লিতে সেনা নামানোর আবেদন করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে টুইটারে উদ্বেগ প্রকাশ করে কেজরিওয়াল লিখেছেন, ‘রাতভর অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ। মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফেরানো যায়নি। এবার সেনা নামানো উচিত। ক্ষতিগ্রস্ত সব জায়গায় অবিলম্বে কারফিউ জারি করা উচিত। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি চিঠি লিখেছি।’
দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মমতা : দিল্লির সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মঙ্গলবার কলকাতা ছাড়ার আগে দেশে শান্তি বজায় রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের কাছে শান্তি বজায় রাখার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। যা চলছে, তা নিয়ে আমরা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন।’
তিনি বলেন, ‘কেন এসব চলছে আমি জানি না। আমরা ঘটনার ওপরে নজর রাখছি। আমি মনে করি, সবার শান্তি বজায় রাখা উচিত। আমাদের দেশ শান্তির দেশ, মানবতার দেশ, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার দেশ। এখানে হিংসার কোনো স্থান নেই।’ দিল্লির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা পুলিশের প্রতিটি থানাকেও সতর্ক করা হয়েছে।
অমিতের ইস্তফা দাবি সোনিয়ার : দিল্লির সংঘর্ষের দায় নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর পদত্যাগ দাবি করেছেন সোনিয়া গান্ধী। বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে সোনিয়া একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দেন অমিতের দিকে। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোথায় ছিলেন? কী করছিলেন তিনি?
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখেও কেন আগে থেকে আধা সেনা ডাকা হল না? এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ। সংঘর্ষ নিয়ে রাজনীতি করার জন্য সোনিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তোলেন তিনি। তিনি বলেন, অনেকে জিজ্ঞেস করছেন অমিত শাহ কোথায়? কিন্তু অমিত শাহ মঙ্গলবারও সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন। যেখানে একজন কংগ্রেস নেতাও উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেস সভানেত্রীর মন্তব্য পুলিশের মনোবল ভাঙতে পারে।
দিল্লি সংঘর্ষে নিহত গোয়েন্দা অফিসারের লাশ মিলল চাঁদবাগে নর্দমায় : দিল্লিতে সংঘর্ষে ফের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) কর্মকর্তা অঙ্কিত শর্মার লাশ বুধবার চাঁদবাগের একটি নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয়। মনে করা হচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের ছোড়া পাথরের আঘাত এবং মারধরের জেরেই তার মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্রীয় দিল্লির বাসিন্দা অঙ্কিত বাড়ি ফেরার সময় মঙ্গলবার চাঁদবাগ সেতুর কাছে একদল লোকের হামলার শিকার হন। বেধড়ক মারধর করে তাকে নর্দমায় ফেলে দেয়া হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন -ভারতকে অ্যামনেস্টি : সিএএ নিয়ে যেসব রাজনৈতিক নেতা সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করেছেন তাদের অবিলম্বে বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
মঙ্গলবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের (ভারত) বিবৃতিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মতো নেতারা সিএএ ইস্যুতে উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এতে বলা হয়, রাজনৈতিক নেতারা উত্তেজনাকর বক্তব্য দিলেও নীরবতা বজায় রেখে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এসবের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানায় অ্যামনেস্টি। অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক অবিনাশ কুমার বলেন, ‘অতীতে ও বর্তমানে যেসব উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্যের কারণে সহিংসতা হয়েছে সেসবের স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হতে হবে। এ দীর্ঘমেয়াদি দায়মুক্তির অবশ্যই অবসান হতে হবে।’