‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : Parstoday
শুক্রবার

৮ এপ্রিল ২০২২

২:২১:২৮ PM
1246024

অনিশ্চিত রাজনৈতিক যাত্রায় পাকিস্তান: চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর হাতে

আবদুর রহমান খান: পাকিস্তানে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এবং জাতীয় সংসদ আবারো একবার মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, গতকাল (৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত রায়ে চারদিন আগে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ভেঙে দেওয়া জাতীয় সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা) :একই সাথে শনিবার (৯ এপ্রিল) সকাল দশটায় সংসদ অধিবেশন ডেকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব সুরাহা করতে বলেছে। বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চালিয়ে যেতে হবে এবং কোনো সদস্যকে সংসদের অধিবেশনে   যোগদানে বাধা দেওয়া যাবে না।

এর আগে গত ৩ এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবকে 'বিদেশি ষড়যন্ত্র' আখ্যায়িত করে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি। এর পর পরই প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে দেশটির প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে এমন নাটকীয় পট-পরিবর্তনের মাঝে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গতরাতে এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, তিনি আজ (০৮ এপ্রিল) তার মন্ত্রিপরিষদের সাথে বসবেন এবং  জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তিনি শেষ বলটি পর্যন্ত খেলে যেতে চান।

পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক ডন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া সংক্রান্ত প্রেসিডেন্টের আদেশকে অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ মর্মে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিয়ে সংবিধানের ৫৮ ধারা লংঘন করেছেন। এ ধারায় বলা আছে, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তা সমাধান না করে সংসদ বিলুপ্ত করা যায় না। 

উচ্চ আদালতের এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

উচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার আগে, প্রধান বিচারপতি বান্দিয়াল শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে মন্তব্য করেন, দেশটিতে বিদ্যুৎসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের মত অর্থ  নেই।  আজকে পাকিস্তানে ডলারের মূল্য ১৯০ রুপি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী সরকার প্রয়োজন।

কেন ইমরানের বিরোধিতা

পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে নির্বাচনে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ বিজয়ী  হবার পর থেকেই বিরোধিতা শুরু হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রভাব খাটিয়ে অন্য দলের সমর্থনে জোড়াতালির সরকারে তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে- এমন অভিযোগ শুরু থেকেই চলে আসছিল।

সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৌতিক সংকট, বৈদেশিক ঋণের বোঝা, রূপির মূল্য মান কমে যাওয়া এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা ইমরান খানের জন্য নতুন সংকটের জন্ম দেয়। এর সাথে যুক্ত হয় আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা।

চীনের প্রতি অধিক নির্ভরতা, সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের অবনতি, তালেবানদের  মদ্ত দিয়ে মার্কিন বাহিনীকে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য করা, ইরান ও রাশিয়ারা সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ'র অগ্রগতির জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে ইমরান খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর  গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের পত্রিকা মিডল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত (৬ এপ্রিল) এক নিবন্ধে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক পিটার অবরনি উল্লেখ করেছেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে ইমরানের অনেক শক্তিশালী দিক রয়েছে। তবে তার মুল দুর্বলতা হচ্ছে- আত্মবিশ্বাস, ইসলামি বিশ্বাস এবং নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত রাখা। 

তবে ইমরানের এবারের সংকট বিস্ফোরিত হয়েছে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বাজদার-এর ব্যাপক দুর্নীতির ফলে। এ ব্যাক্তি পাঞ্জাবে ইমরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। তাই রাজনৈতিক কারণেই ঝড় ইমরানের বিপক্ষে বইতে শুরু করে।

ইমরান খানের সরকারের গত তিন বছরে বিরোধী নেতাদের দিন কেটেছে কারাগারে, আদালত চত্বরে এবং দুর্নীতির অভিযোগ সামলাতে। এতদিনে তারাও নিজেদের মধ্যে একরকম সমঝতায় পৌঁছেছে যে, ইমরান সরকারের পতন ঘটাতে হবে, যে করেই হোক না কেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তা্নের রাজনীতিতে প্রভাবশালী  শক্তি সেনাবাহিনীর উর্ধ্বমহলের সহানুভূতিও কিছুটা যোগাড় করা গেছে বলে  পর্যবেক্ষকগণ মনে করছেন।

ওয়াশিংটন পোস্ট উল্লেখ করেছে, গতবছর থেকে সেনাপ্রধান ওমর বাজওয়া’র সাথে ইমরান খানের সরকারের মতান্তর দেখা দিতে শুরু করে। সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক সংকট এবং দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতা নিয়ে এ বিরোধ স্পষ্ট হতে শুরু করে।

তবে প্রধান বিরোধটা দেখা দেয় পররাষ্টনীতি প্রসঙ্গে। তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র  করার দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে ইমরান খান প্রকাশ্যে বক্তব্য দিলেও  তার সেনাপ্রধান মার্কিনীদের 'ঘনিষ্ঠ মিত্র' হিসেবে উল্লেখ করছেন।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুটিয়ে নিতে ইমরানের দাবি এবং রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ  আমেরিকাকে বেশ অসন্তুষ্ট করেছে।

উইওন বার্তা সংস্থা মস্কো থেকে পরিবেশিত এক খবরে জানিয়েছে, রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির জন্য ইমরানকে সায়েস্তা করতে চাইছে আমেরিকা। রাশিয়ার  ইউক্রেন অভিযানের প্রস্তুতি পর্বে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইমরান খান মস্কো সফর করেছেন। আমেরিকার পক্ষ থেকে এ নিয়ে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে বলে ইমরান  নিজেই দাবি করেছেন।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, আমেরিকা পাকিস্তানের রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে।

কী হতে পারে

আদালত নির্দেশিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের শনিবারের অধিবেশনে কী হবে?  ইমরান খান চাইছে তার সরকার ও সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন আগাম নির্বাচন দেওয়া হোক। আর বিরোধীরা চাইছেন অনাস্থা ভোটে ইমরানের সরকার পতন হোক এবং বর্তমান সংসদের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোক। নতুন সরকার গঠিত হোক। মেয়াদ পুর্তি পর্যন্ত পার্লামেন্ট বহাল থাকুক।

ইমরানকে হটিয়ে বিরোধীরা যদি সরকার গঠন করে সেক্ষেত্রে ইমরান তার গণমূখী কৌশল অবলম্বন করে বিরোধিতায় নামবে এবং আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করবেন এটা অবধারিত।   

এ অবস্থায় সকল পক্ষকে নিয়ে একটা সর্বসম্মত নির্বাচন অনুষ্ঠান বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।

তবে, অনেককিছুই নির্ভর করছে দেশটির সেনাবাহিনী কী ভূমিকা নেবে তার ওপর। রাজনৈতিক সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং অর্থনৈতিক সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠে, তবে অতীতের মতো আরও একবার পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে সেনাবাহিনী। #

342/