সিয়াম শুধু আমাদের উপর ফরয করা হয়নি বরং আমাদের পূর্ববর্তী উম্মাহ’র জন্যও ফরয ছিলো। সিয়ামের উদ্দেশ্য শুধু কষ্ট করা নয় বরং কল্যাণ লাভ করা এবং তাকওয়া বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ভয় মনে রাখা। যেমন আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿١٨٣﴾
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার”। (বাকারাহ : ১৮৩)
যেহেতু তাকওয়া বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ভয় মনে রেখে চলার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত কল্যাণ। তাই তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গড়ার লক্ষ্যে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন আমাদের উপর রমযান মাসে সিয়াম সাধনা বা রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ ۚ
فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ
“রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে”। (বাকারাহ : ১৮৫)
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল উজমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ী এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন-
“মাহে রমযান অর্থ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি! মাহে রমযানকে মাহে-মোবারক বলার কারণ হচ্ছে, এই মাস হচ্ছে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতের পথে সফল পদচারণা করার মাস! আর এই কারণেই মাহে রমযানের দুয়ার মধ্যে বলা হয়: وهذا شهر العتق من النار و الفوز بالجنه তাই বলা যায় যে, জাহান্নামের আগুন ও জান্নাতে আল্লাহর নিয়ামতের নমুনা এই দুনিয়াতেই রয়েছে অর্থাৎ পারলৌকিক প্রশান্তি ও খুশির বিষয়ে যত বেশী চিন্তা-ভাবনা করা হবে ততই এই অন্তর্নিহিত এই তাৎপর্য যা এখানে বলা হয়েছে, স্পষ্ট হয়ে উঠবে”!
রমাযানই একমাত্র মাস যার নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমানদের কাছে এ মাসের একটি বিশেষ স্থান ও সম্মান রয়েছে তাই মুসলমানরা এই মাসে ইবাদতের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন। এ মাসে বিভিন্ন আমল ও দোয়াপাঠের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল যেমন: কোরআন তেলাওয়াত, বেশী বেশী মুস্তাহাব নামাজ আদায় করা, দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা, ইফতারি প্রদান করা এবং অভাবগ্রস্তকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
এ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এর কোন একটি রাত হল কদরের রাত, আর এ মাসেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। রমজান মাসের ২১ তারিখে প্রথম ইমাম হযরত আলীর (আ.) শাহাদাত দিবস। ইমাম হাসান মুজতাবাও (আ.) এই মাসের ১৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।
মহান কদরের রাত, যাতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে এবং যা ১০০০ মাসের চেয়েও উত্তম, সেই বরকতপূর্ণ রাতকে আমরা এ মাসেই উপলব্ধি করতে পারি। আরও কিছু আসমানী কিতাব এই মাসে নাযিল হয়েছে।
রমযানের ফজিলত:
রমাযানের ছিয়াম আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাঁর বান্দাদের জন্য একটি বিশেষ নি’মাত। আর তা পালনের অফুরন্ত প্রতিদানও মহান আল্লাহর নিকটে রয়েছে। রোজার কল্যাণ উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَأَن تَصُومُوا خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ ﴿١٨٤﴾
“আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার”। (বাকারাহ : ১৮৪)
হাদীসে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘ছিয়াম স্বতন্ত্র, তা আমারই জন্য। আর আমিই তার প্রতিদান দিব’।
মহানবী (সা.) তাঁর খুতবায়ে শা’বানীয়াতে রমযান মাসের বেশ কিছু ফজিলত বর্ণনা করেছেন যেমন তিনি বলেছেন:
১. মানুষকে রমযান মাসে মহান আল্লাহর মেহমান হওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানানো হয়।
২. এ মাসের কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
৩. এই মাসের যে কোন রাতে নামাজ আদায় করা ও আল্লাহর ইবাদতে রাত্রি-জাগরণ করা অন্য মাসে ৭০ রাতের ইবাদতের সমতুল্য।
৪. রমযান মাস ধৈর্যের প্রতিক আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত।
৫. রমযান হচ্ছে পরস্পর সহানুভূতি প্রকাশের মাস
৬. এ এমন এক মাস যাতে মুমিনদের রুজি বৃদ্ধি করা হয়।
৭. এ মাসে ইফতারি প্রদানের মধ্যে একজন দাস মুক্ত করার সমান সাওয়াব রয়েছে!
৮. এই মাসে জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।
রাসুল (সাঃ) এর বর্ণনায়- রমাযান এমন একটি মাস, যার মূল্য জানা থাকলে, মানুষ চাইত সারা বছর রমযান মাস থাকুক।
অন্য হাদিসে রমযান মাসের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে: এটা মাগফিরাতের মাস যে বান্দাকে এই মাসে ক্ষমা না করা হয়, অন্য মাসে তার ক্ষমা পাওয়ার আশা কম থাকে; রমযান মাসকে রমযান বলার কারণ হয়েছে, এটি পাপ ও গুনাহ পুড়িয়ে দেয়।
রামাযানের আমল:
মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মাস হচ্ছে রমজান মাস। বিশেষ কিছু দুয়া রয়েছে যেগুলি এই মাসে বারবার পাঠ করা হয়, যেমন: দুয়ায়ে "আবু হামজা সুমালি", দুয়ায়ে "ইয়া আলিউ ইয়া আজিম", “আল্লাহুম্মা আদখিল আলা আহলিল কুবুরিস-সুরুর” এবং “আল্লাহুমারজুকনি হাজ্জা বায়ইতিকাল-হারাম” ইত্যাদি। রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার বিশেষ সওয়াব ও ফজিলত রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালার মহান উপহার মাহে রমযানে পেছনে ফেলে আসা পাপরাশীকে সিয়াম, কিয়াম ও অন্যান্য কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে যেন ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে নিতে পারি এবং আল্লাহর অশেষ রহমতের বারি ধারায় সিক্ত হয়ে, নতুন করে পথ চলা শুরু করতে পারি।
নিঃসন্দেহে রমাযান মুসলিমদের জন্য এক বিরাট কল্যাণের মাস। আল্লাহ আমাদেরকে রামাযানের হক আদায় করে রোযা রাখার তাওফিক দিন।
আমীন!
#176