‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ABNA
শুক্রবার

৭ এপ্রিল ২০২৩

৯:২৯:৪৬ AM
1356581

মহানবী (সা.) ইমাম হাসান মুজতাবাকে অত্যাধিক ভালোবাসতেন, হাদিসে উল্লেখ আছে যে, তিনি ইমাম হাসানকে (আ.) কাঁধে বসিয়ে বলতেন: হে আল্লাহ, আমি তাঁকে ভালোবাসি, তুমিও তাঁকে ভালোবাসো!

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা যাহরার (আ.) প্রথম সন্তান হযরত হাসান বিন আলী (আ.)। রসূলুল্লাহর (স:) ওফাতের সময়ে ইমাম হাসান মুজতাবার বয়স হয়ে ছিল ৭ বছর। নবী (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রায় ত্রিশ বছর তিনি তাঁর পিতা ইমাম আলীর (আ.) সাথে ছিলেন। তাঁর পিতার শাহাদাতের পর (৪০ হিজরীতে), জন-সাধারণ ইমাম আলীর (আ.) উত্তরসূরি হিসেবে ইমাম হাসান আল-মুজতাবার (আ.) নিকট বাইয়াত (আনুগত্যের অঙ্গীকার) করেছিল, কিন্তু মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থনের অভাবের কারণে, বাধ্য হয়ে তিনি ৪১ হিজরীতে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেন। তাঁর ইমামতের মেয়াদ ছিল ১০ বছর। ৫০ হিজরিতে যখন তাঁর বয়স ৪৮ বছর ছিল, মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগ করে তাকে শহীদ করা হয়।

জন্ম

ইমাম হাসান আল-মুজতবা (আ.) রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের সন নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কারো মতে দ্বিতীয় হিজরী সনে, আবার কেউ হিজরী তৃতীয় সনে হযরতের জন্ম হয়েছিল বলে মনে করেন।

হযরতের লাকাবসমূহ:

ইমাম হাসানের অনেক লাকাব বা উপাধির কথা মাশহুর হয়ে আছে, যেমন তাকী, তৈয়্যেব, জাকি, সাইয়্যেদ, মুজতবা প্রভৃতি, যার মধ্যে সাইয়্যেদ উপাধি তাঁকে স্বয়ং মহানবী (সা.) দিয়েছিলেন। এসবের মধ্যে তাঁর প্রসিদ্ধতম ডাক নাম "আবু মুহাম্মদ" বলে বর্ণিত আছে।

ইমাম হাসান (আ.) এর যুগে মহানবী (সা.)।

মহানবী (সা.) ইমাম হাসান মুজতাবাকে অত্যাধিক ভালোবাসতেন, হাদিসে উল্লেখ আছে যে, তিনি ইমাম হাসানকে (আ.) কাঁধে বসিয়ে বলতেন: হে আল্লাহ, আমি তাঁকে ভালোবাসি, তুমিও তাঁকে ভালোবাসো!

 

মহানবীর (সা.) একটি বর্ণনায়, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.) এর ইমামতের প্রতি গুরুত্ব তুলে ধরতে যেয়ে বলেছেন: "জুলমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে তারা উঠে দাড়াক কিংবা বসে থাকুক উভয় অবস্থায় হাসান ও হোসাইন হচ্ছেন ইমাম।" [মানাকিব আল আবি তালিব, (আ:), ইবনে শাহুর আশুব, ভলিউম ৩, পৃ. ৩৯৪।]

অন্য হাদিসে তিনি বলেনঃ ‍“হাসান ও হুসাইন বেহেশতি যুবকদের নেতা”। এই হাদীসটি আহলে তাশাইয়ু ও আহলে সুন্নাতের অনেক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।

মহানবী (সা.) এর সময়ে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিতে ইমাম হাসান (আ.) উপস্থিত ছিলেন, এই সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি মহান আল্লাহ ও মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টিতে তাঁর উচ্চ মাকাম ও অবস্থানের কথাই প্রকাশ করে। যেমনঃ

১. নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে মহানবীর (স:) মুবাহেলার ঘটনায় ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) কে "ابنائنا" বা আমাদের পুত্রগণ হিসাবে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২.  আয়াতে-তাতহিরের শানে-নজুলে, মহানবী (স:) তাঁর বিশেষ চাদরের মধ্যে আহলে বাইতের উদাহরণ ও নমুনা হিসেবে ইমাম হাসানকেও (আ:) শামিল করেছিলেন!

৩. আহলে বাইতের (আ:) মহান শান ও মর্যাদায় নাযিল হওয়া সূরা আল-ইনসানের প্রক্ষোপটেও ইমাম হাসান (আ:) শামিল রয়েছেন।

হযরতের প্রজ্ঞা, চরিত্র ও  চেতনার মাহাত্ম্য এতই বেশি ছিল যে, বয়সের দিক থেকে ইমাম অনেক ছোট হলেও কিছু চুক্তিতে মহানবি (স:) তাঁর সাক্ষ্য গ্রহন করেছেন। ওয়াকেদি উল্লেখ করেছেন- খালেদ বিন সাঈদের লিখিত জামানত-নামার চুক্তিপত্রে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন এর সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়েছে। [পিশভই দোভ্ম হযরত ইমাম হাসান (আ.), ইনস্টিটিউট অব প্রিন্সিপলস অব রিলিজিয়ন, কোম।]

মহানবী (স:) তাঁর অনেক সাহাবিকে, স্নেহ, আদব, নৈতিকতা এবং শিশু লালন-পালনের পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে, ইমাম হসান ও হুসাইন (আ.)-এর উপর করা বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে শিখিয়েছেন।

 

ইমাম হাসান (আ.) ইমাম আলী (আ.) এর যুগেঃ

ইমাম আলী (আ.) এর জীবদ্দশায় ইমাম হাসান (আ.) সর্বদাই তাঁর পিতার সাথে ছিলেন। আবুযারকে যখন রাবাজাতে নির্বাসিত করা হচ্ছিল, তখন খলিফা উসমানের পক্ষ থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল যেন কেউ তাকে বিদায় সম্ভাষন জানাতে না যায়, কিন্তু ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাদের পিতা হযরত আলি (আ:) একত্রে তাকে বিদায় জানাতে যান এবং উষ্ণ সম্ভাষন জ্ঞাপন করে খলিফা উসমানের প্রতি তাদের ক্ষোভের বিষয়টি তুলে ধরেন। পরিশেষে আবুযারকে ধৈর্যধারণ করার পরামর্শ দেন।

হজরত আয়েশা, তালহা ও জুবায়ের কর্তৃক প্রজ্বলিত জামাল যুদ্ধের আগুন নেভানোর জন্য, ৩৬ হিজরীতে ইমাম হাসান (আ:) তার পিতার সাথে মদীনা থেকে বসরায় গমন করেন। এই যুদ্ধে ইমাম হাসান হজরত আয়েশার উঠের পা কেটে দেওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দেন।

পরবর্তিতে হজরত আলী (রা.)-এর নির্দেশে বসরায় প্রবেশের আগে তিনি রাসুলের বিখ্যাত সাহাবি হযরত আম্মারকে সাথে নিয়ে কুফার জনগণকে একত্রিত করেন এবং বসরায় ফিরে আসেন।

সিফফিনের যুদ্ধেও তিনি নিজ পিতার পক্ষে বাগী-মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সাফফিনের যুদ্ধের সময় মুয়াবিয়া উবায়দুল্লাহ ইবনে উমরকে ইমাম হাসানের কাছে বিশেষ বার্তা দিয়ে পাঠান যাতে বলা হয়ে ছিল: "তোমার পিতার অনুসরণ করা থেকে বিরত থাক, আমরা তোমার কাছে খিলাফত ছেড়ে দেব, কারণ অতীতের যুদ্ধ এবং হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে কুরাইশরা তোমার পিতার প্রতি বিরক্ত, তবে তারা তোমাকে মেনে নিতে পারে।"

ইমাম হাসান (আ.) উত্তরে বলেন: "কুরাইশরা ইসলামের পতাকাকে ভূ-লন্ঠিত করতে চেয়েছিল কিন্তু আমার পিতা, আল্লাহ এবং ইসলামের জন্য, অবাধ্য ও বিরোধিতাকারীদের হত্যা করেন এবং তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিলেন, আর এই কারণে তারা আমার পিতার সাথে শত্রুতা করে এবং ক্ষোভ পোষণ করে।" ] হায়াতুল ইমাম আল-হাসান বিন আলী, ভলিউম ১, পৃ. ৪৪৪-৪৪৫] 

ইসলামের নবী (সা.) এর আদেশ অনুসারে ‍“ইমাম আলী (আ.) মৃত্যুর সময়, ‍ইমাম হাসান (আ.) কে তাঁর উত্তরসূরি নিয়োগ করে ছিলেন এবং ইমাম হুসাইনসহ তাঁর অন্যান্য সন্তানের সাথে প্রবীণ-শিয়াদেরকে এ বিষয়ে সাক্ষী রাখেন”। [উসুল কাফী, ১ম খন্ড, পৃ. ২৯৮-২৯৭]

ইমাম হাসানের খেলাফতঃ

যখন হযরত আলী (আ.) ইন্তেকাল করেন, তখন ইমাম হাসান (আ.) জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। খেলাফতের শুরুতে দেওয়া ইমামের খুতবাটি আল্লামা হিল্লী নিম্নরূপ উদ্ধৃত করেছেন: “সেই রাতে যখন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ:) ইন্তেকাল করেন- সকালে ইমাম হাসান জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন, প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং নবীর প্রতি দূরুদ ও সালাম প্রেরণ করেন, অতঃপর তিনি বলেন- "গত রাতে, তোমাদের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি চলে গেছেন, যার পূর্বসূরিরা সৎকর্মে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মও তাঁর সমকক্ষতায় পৌঁছাতে পারবে না। অতঃপর জনগণের উপর তাঁর (নেতৃত্বের অধিকার) ব্যাখ্যা করেন এবং তাঁর পিতার স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন- আমার পিতা সর্বদা রাসুলের (স:) সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন। নিজের জীবন দিয়ে আল্লাহর রসূলে জীবনকে রক্ষা করেছেন।

এ সময় ইমাম হাসান (আ.) কাঁদতে থাকেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর সাথে কাঁদতে থাকেন। পরিশেষে তিনি বললেনঃ "আমি সুসংবাদ প্রদানকারী আল্লাহর রসূলের সন্তান। আমি সেই ব্যক্তির পুত্র যিনি মানুষকে আল্লাহর নির্দেশে, আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছেন। আমি হেদায়েতের উজ্জ্বল প্রদীপের সন্তান। আমি সেই পরিবারের সন্তান যাদের থেকে আল্লাহ নোংরামি ও অপবিত্রতাকে দূরে রেখেছেন এবং সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করেছেন। আমি এমন একটি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত যাদের জন্য ভালোবাসা রাখাকে মহান আল্লাহ্ বাধ্যতামূলক করে বলেছেন: ‍-হে নবী! বলুন, আমার নিকট আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি ভালবাসা ছাড়া, আমি রেসালাতের কোন প্রতিদান চাই না।- সৎকর্ম বা কল্যাণকর যা কিছু করা হয়, আল্লাহ তা আরো বৃদ্ধি করে দেন। এখানে সৎ কর্ম বা কল্যাণকর কাজ বলতে, আমাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করার কথা বুঝানো হয়েছে। অতপরঃ বক্তৃতা শেষ করে তিনি বসে পড়েন”। [নেগাহি বার জেন্দগীয়ে দাওয়াজদা ইমাম, আল্লামা হিল্লি, মোহাম্মদ মোহাম্মদী এশতেহার্দি কর্তৃক অনুবাদকৃত, গাদির তথ্য কেন্দ্রের ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত।]

খুতবা শেষ হওয়ার পর, ইবনে আব্বাস উঠে দাঁড়ালেন এবং লোকদেরকে ইমাম হাসানের প্রতি আনুগত্যে প্রকাশের বাইয়াত করতে বলেন। [আল-ইরশাদ, শেখ মুফিদ, খণ্ড ২, পৃ. ৯]

মুয়াবিয়ার সাথে ইমাম হাসান (আ.)-এর শান্তি-চুক্তিঃ

ইমাম হাসান (আ.)-এর খিলাফতের প্রতি ইরাকের জনগণ আনুগত্যের ঘোষণা দেওয়ার পর হিজাজ, ইয়েমেন ও পারস্যের জনগণও বাইয়াতের ঘোষণা দেয়। মুয়াবিয়া এই খবর জানতে পেরে এই নিয়োগের নিন্দা করে এবং চিঠিতে ইমাম হাসানকে খলিফা হিসাবে মান্য না করার এবং স্বীকৃতি না দেওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। [তাশি দার মাসিরে তরিখ, হোসাইন মোহাম্মদ জাফারি, সাইয়্যেদ মোহাম্মদ তাকি আয়াতুল্লাহি দ্বারা অনুবাদিত, তেহরান: ফারহাং ইসলামিক পাবলিশিং হাউস, পৃ. ১৬২।]

মুয়াবিয়ার ভণ্ডামি ও নিজ সৈন্যদের বিশ্বাসঘাতকতার প্রভাবে ইমামের বাহিনী দূর্বল হয়ে পড়েছিল এবং সামরিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল, এর ফলে ইমাম হাসান (আ.) একটি অবাঞ্ছিত শান্তি-চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং কিছু শর্তের ভিত্তিতে, তিনি মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ানের কাছে খিলাফত ছেড়ে দেন।

ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদাত:

শান্তি-চুক্তির পর, মুয়াবিয়া চুক্তির সব বিধান লঙ্ঘন করতে শুরু করে এবং তার পুত্র ইয়াজিদের ক্ষমতা লাভের পথ প্রশস্ত করার জন্য, ইমাম হাসান (আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। শেখ মফিদের বর্ণনা অনুসারে, ‍“মুয়াবিয়া যখন তার ছেলে ইয়াজিদের গভর্নরশিপের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন সে আশআস বিন কায়সের কন্যা, (ইমাম হাসানের স্ত্রী) জায়েদার কাছে এক লাখ দিরহাম পাঠিয়ে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ইমামকে বিষ খাওয়ানোর বিনিময়ে তাকে ইয়াজিদের সাথে বিয়ে দিবে”। [শেখ মুফিদ, আল-এরশাদ, ১৪১৩ হি, খন্ড ২, পৃ. ১৫।] এই প্রতিশ্রুতিতে প্রলুব্ধ হয়ে আশআস বিন কায়সের কন্যা জায়েদা, ইমাম হাসানকে বিষ পান করিয়ে হত্য করে! ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রজিউন। ইমামের শাহাদাতের তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে এবং তাঁর শাহাদাতের বছর সম্পর্কে ৪৯, ৫০ ও ৫১ হিজরির কথা উল্লেখ করে তিনটি বর্ণনা রয়েছে।#176