‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : Parstoday
সোমবার

১১ মার্চ ২০২৪

২:১৯:০১ PM
1443662

জনপ্রিয় ইরানি কমান্ডার ছিলেন ইব্রাহিম হিম্মাত: তাঁর জীবনে শিক্ষামূলক নানা ঘটনা

ইরানের জনপ্রিয় সামরিক কমান্ডার ছিলেন ইব্রাহিম হিম্মাত। গত সাত মার্চ তার শাহাদাত বার্ষিকী পালিত হলো। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় তিনি শহীদ হয়েছিলেন। এ উপলক্ষে আজকের আলোচনায় আমরা মাত্র ২৮ বছর বয়সে শহীদ ইব্রাহিম হিম্মাতের জীবনের নানা দিক তুলে ধরবো।

১. তিনি ছিলেন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি:

ইব্রাহিম হিম্মাত ছিলেন তার পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। তিনি ১৯৫৫ সালের ২ এপ্রিল ইরানের ইস্পাহান প্রদেশের শাহরেজা উপশহরে একটি দরিদ্র ও ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্কুলে পড়াশোনার অবকাশে বিশেষ করে গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রচুর কায়িক পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করতেন। এভাবে, তিনি তার পরিবারকে আর্থিকভাবে অনেক সাহায্য করতেন।

২. তিনি ছিলেন সংগ্রামী ছাত্র:

ইব্রাহিম হিম্মাত ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ১০৭৩ সালে উচ্চতর নম্বর পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর হিম্মাত ইস্পাহান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর বাধ্যতামূলকভাবে তিন বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে নিজ শহরে ফিরে আসেন। কিছুদিন তিনি শাহরেজা ও আশেপাশের গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ইতিহাস পড়ান। এই সময়, তিনি মার্কিন সমর্থিত ইরানের পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধেও তৎপরতা শুরু করেন। হিম্মাত পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন সংগ্রামকে জোরদার করেন। বলা যায় তিনি ওই এলাকার সরকার বিরোধী আন্দোলনে যুবকদের নেতৃত্ব দেন।

৩. সরকারের ঘোষিত সন্ত্রাসীদের তালিকায় ইব্রাহিম হিম্মাত:

শাহের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ ও আন্দোলনে হিম্মাত অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। সরকার বিরোধী কার্যকলাপের কারণে ইস্পাহানের সামরিক গভর্নর তাঁকে হত্যা ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়ার আগ পর্যন্ত শাহের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা 'সাভাক' বেশ কয়েকবার হিম্মাতকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু, মৃত্যুর পরোয়া না করে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় পর্যন্ত  তিনি তার পোশাক ও চেহারা পরিবর্তন করে বিভিন্ন শহরে রেজাশাহের শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান এবং জনগণকে সংগঠিত করতে থাকেন।

৪. ইসলামি বিপ্লবী কমিটি:

ইরানে পাহলভি শাসনের পতন এবং ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর, হিম্মাত পুনর্গঠন কাজের জন্য শাহরেজা উপশহরে ইসলামি বিপ্লবী কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর কিছু সময় পর তিনি শাহরেজায় নব গঠিত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর জনসংযোগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

৫. অধিনায়কত্ব:

ইরাকের সাদ্দাম সরকারের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র তৎকালীন কমান্ডার মোহসেন রেজাই-এর নির্দেশে ইব্রাহিম হিম্মাত এবং আহমাদ মোতাওয়াসসেলিয়ানকে 'মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ ব্রিগেড' গঠনের জন্য দেশের দক্ষিণ ফ্রন্টে পাঠানো হয়েছিল। মোহাম্মদ ইব্রাহিম হিম্মাত তার বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মানসিকতার কারণে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। 'ওয়াল ফাজর-চার' অপারেশনে তার কমান্ডের অধীনে ২৭ তম ডিভিশনের অপারেশনের গতি ছিল অসাধারণ এবং সবাইকে বিস্মিত করেছিল।

৬. ইসরাইলি শয়তানি চক্রান্তের বিরুদ্ধে হিম্মাতির লড়াই:

ফার্সি ১৩৬১ সালে, দক্ষিণ লেবাননে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে, হিম্মাতি লেবাননকে সমর্থন ও সহযোগিতা করার জন্য ওই দেশে যান এবং কিছু কার্যক্রম সংগঠিত করে ইরানে ফিরে আসেন।

৭. শাহাদাত:

খাইবার অপারেশনের সময় ইরানি বাহিনী যখন সাদ্দামের বাহিনীকে প্রতিহত করছিল, তখন হিম্মাত যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখার জন্য সামনে এগিয়ে গেলে তিনি ইরাকি বাহিনীর কামানের গোলার মুখে পড়েন। গোলার আঘাতে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তিনি শহীদ হন।

সেনাবাহিনী ও যুদ্ধ পরিচালনায় শহীদ হিম্মাতের কিছু বৈশিষ্ট্য :

১. যোদ্ধা নির্বাচনের বিচক্ষণতা

তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সামরিক ক্ষেত্রে সঠিক ও যোগ্য ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা এবং তাদেরকে কাজে লাগানো। তিনি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও সুনিপুণ।  অতএব, তিনি যাদের মনোনীত করেছিলেন তারা যুদ্ধের ময়দানে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন।

২. আমি তোমার থেকে কম

তাঁর সম্পর্কে যেমনটি বলা হয়েছে, হিম্মাত কখনোই নিজেকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন না। বারবার, তিনি নিজেকে যুদ্ধের ময়দানে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজ-এর চেয়ে নিজেকে অনেক খাটো করে দেখাতেন এবং বলতেন, 'আমি কোথায় আর আল্লাহর জন্য নিবেদিত প্রাণ এই স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী কোথায়?'

৩. শক্তি বাড়াতে হবে

 তিনি জোর দিয়ে বলতেন, সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়াতে হবে এবং কমান্ডারদের উচিত তাদের কমান্ডের অধীন বাহিনীকে উচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। প্রকৃতপক্ষে, হিম্মাত চেয়েছিলেন ভবিষ্যতের জন্য এই বাহিনীকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে গড়ে তুলতে হবে। 

৪. আমার কাজের সমালোচনা করুন এবং পরামর্শ দিন

ইব্রাহিম হিম্মাত সেনাবাহিনীর কমান্ডের দায়িত্ব পালনকালে তার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তাকে কেউ সমালোচনা করলে তিনি খুব সহজভাবে নিতেন। তার কাজ সম্পর্কে কারো মতামত বা কিছু পরামর্শ থাকলে তিনি তা মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং এ কথা বলতেন না যে, "আমি সেনাপতি এবং তোমার চাইতে আমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে।" হিম্মাত যদি বুঝতেন  কোনো ব্যক্তির যুদ্ধের সক্ষমতা, ধারণা ও পরিকল্পনা অনেক বেশি তাহলে দ্রুত সেই ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করতেন।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র সাবেক কমান্ডার মোহসেন রেজাই 'হিম্মাত' সম্পর্কে বলেছেন, "আসলে, আমাদের এমন চারটি বাহিনী ছিল যে, তারা যখন কোথাও প্রবেশ করতো, তাদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তি বা সাহস কারো হতো না। ইব্রাহিম হিম্মাত ছিলেন '২৭-মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ ব্রিগেডের কমান্ডার। হোসাইন খাররাজী ছিলেন ১৪-ইমাম হুসাইন ব্রিগেডের কমান্ডার, মেহেদি বাকেরি ছিলেন ৩১-আশুরা ব্রিগেডের কমান্ডার এবং আহমাদ কাজেমি ছিলেন ৮-নাজাফ ব্রিগেডের কমান্ডার। এই চার বাহিনী যেখানেই প্রবেশ করতো বা অভিযানে নামতো সন্দেহাতীতভাবে তারা সফল হতো।