আজকের এ আলোচনায় আমরা গাজা যুদ্ধ সম্পর্কে ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর সাতটি মিথ্যাচার নিয়ে কথা বলব।
১- কে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে?
ইহুদিবাদীদের প্রথম মিথ্যাচার ছিল এই যে, ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন ‘হামাস’ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আল-আকসা তুফান অভিযান শুরু করেছে। ইহুদিবাদী বাহিনী এমন সময় এই দাবি করেছে যখন তারা হামাসের ৭ অক্টোবর অভিযানের আগে বহুবার গাজায় আগ্রাসন চালিয়েছে এবং জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ২৩০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে শহীদ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, আল-আকসা তুফান অভিযানের অনেক আগে থেকে ইসরাইলই গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আসছিল।
২- ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তি; অগ্রাধিকার নিয়ে ভুয়া তথ্য!
দ্বিতীয় মিথ্যাচার ছিল ইসরাইলের এই দাবি যে, তারা গাজা উপত্যকায় আটক ইহুদিবাদী বন্দিদের মুক্ত করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
মার্কিন টিভি উপস্থাপক মেহেদি হাসানের মতে, বাস্তবতা হল এই বিষয়টিকে ইসরাইলিরা অগ্রাধিকার দিচ্ছে না বরং গাজায় প্রচুর সংখ্যক ইসরাইলি বন্দি ইহুদিবাদী বাহিনীর বোমাবর্ষণ, গুলি ও বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে।
৩- নবজাতকদের গলা কাটা; শিশুদের হত্যাকারী কে?
ইসরাইলের তৃতীয় মিথ্যাচার ছিল হামাস যোদ্ধাদের হাতে ইসরাইলি শিশুদের শিরশ্ছেদ।
এটি ছিল এমন একটি মিথ্যা যা যাচই বাছাই ছাড়া প্রকাশ করে মার্কিন নিউজ চ্যানেল সিএনএনের রিপোর্টার ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ইসরাইল ব্যাপকভাবে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রচার করেছিল কিন্তু কোনো প্রমাণ দেয়নি। পরে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
সিএনএনের রিপোর্টার ‘সারা সিডনার’ সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এই ডাহা মিথ্যা সম্পর্কে লিখেছেন, “ইসরাইল ঘোষণা করেছে যে, তারা শিশুদের মাথা কেটে ফেলার বিষয়ে নেতানিয়াহুর অফিসের দাবির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি। আমার এ বিষয়ে আমার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল এবং আমি এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।”
৪- চতুর্থ মিথ্যাচার; আশ-শিফা হাসপাতালে হামাসের কমান্ড সেন্টার
আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে গাজার হাসপাতালগুলিতে ইহুদিবাদী বাহিনীর নির্বিচার হামলার ব্যাপক সমালোচনা হওয়ার পর ইসরাইলিরা তাদের এই অপরাধকে ন্যায্যতা দেয়ার লক্ষ্যে একটি নতুন মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়। আর সেটি ছিল এই দাবি করা যে, আশ-শিফা হাসপাতালসহ গাজার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে সেন্টারগুলিতে হামাসের কমান্ড সেন্টার অবস্থিত।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই মিথ্যাচারটির স্বরূপ উন্মোচন করেছে।
যখন ইহুদিবাদীরা আশ-শিফা হাসপাতালে হামলা করে এবং এটির বেজমেন্টে পৌঁছায় তখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি জানায় যে, এই হাসপাতালে হামাস বাহিনীর কোনো কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র নেই।
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে, এই দাবি মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৫- পঞ্চম মিথ্যাচার; ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে আস্থার অভাব
গাজায় ইসরাইলের হামলায় বিপুল সংখ্যক মানুষ শহীদ ও আহত হওয়ার পর ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ইসরাইলি সেনা মুখপাত্র দাবি করে যে, ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিশ্বাস করা যায় না। অথচ ইসরাইলি সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা গাজার হতাহতের পরিসংখ্যান পাওয়ার ক্ষেত্রে এই উপগত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাইরে অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র খুঁজে পায়নি। আর হিব্রু ভাষার বিখ্যাত সংবাদপত্রগুলি এখন গাজার এই সূত্র থেকে হতাহতের খবর সংগ্রহ করছে।
সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় ইহুদিবাদী সেনাদের নির্বিচার গণহত্যা অভিযানে ৩১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৭২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
৬- ষষ্ঠ মিথ্যাচার; গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি
ষষ্ঠ মিথ্যা হল ইসরাইলের এই দাবি যে, গাজায় দুর্ভিক্ষ নেই।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি ইসরাইলের এই দাবিটি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিল ‘ইউনিসেফ’ এর মুখপাত্র ‘জেমস এল্ডার’ সম্প্রতি গাজার মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে, গাজার দুর্যোগ বর্ণনা করার জন্য কোন উপযুক্ত শব্দ তার জানা নেই।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক উপ-মহাসচিব ‘মার্টিন গ্রিফিথস’ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, গাজার পাঁচ লাখ অধিবাসী দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
সপ্তম মিথ্যাচার; ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার জন্য হামাস দায়ী
তেল আবিবের সপ্তম মিথ্যাচার হলো এই দাবি করা যে, হামাসকে ভোট দেয়ার কারণে গাজাবাসীকে নির্বিচারে মারা পড়তে হচ্ছে! এমন সময় এ দাবি করা হচ্ছে যখন গাজায় সর্বশেষ নির্বাচন প্রায় ২০ বছর আগে অনুষ্ঠিত হয় এবং আজ যারা শহীদ হচ্ছে তখন তাদের অনেকের জন্মও হয়নি।
ইহুদিবাদী ইসরাইল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে পশ্চিমা দেশগুলির পূর্ণ সমর্থনে গাজা উপত্যকা ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের অসহায় ও নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসকের পরিকল্পনায় বিভিন্ন দেশ থেকে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদিদের অভিবাসনের মাধ্যমে আজকের ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটি তৈরি করা হয় এবং ১৯৪৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর অস্তিত্ব ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে গোটা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে বহু গণহত্যা এবং জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে ইসরাইল।#