গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বর্তমান কানাডাসহ আমেরিকার আদিবাসী শিশুদেরকে জোর করে দিবা-নিশি বা ডে-নাইট স্কুলগুলোতে নিয়ে আসার পর তারা সেখানে স্কুলের কর্মীদের হাতে নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হত।
ডেইলি মেইলের বরাত দিয়ে পার্সটুডে ম্যাগাজিন জানিয়েছে, মার্কিন ফেডারেল সরকার পরিকল্পিত কর্মসূচির আওতায় স্থানীয় আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করতে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শিশুদের জন্য গড়ে তোলে ৫০০'রও বেশি ডে-নাইট স্কুল যাতে সেখানে পড়াশুনার কথা বলে তাদেরকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। ওয়াশিংটন পোস্টের গবেষণায় দেখা গেছে কিভাবে এইসব স্কুল যৌন রোগীদের অপরাধের পথ খুলে দিয়েছিল।
এইসব স্কুলে দুটি বড় অপরাধযজ্ঞ হয়েছিল: প্রথমত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় অভিবাসীরা স্থানীয় আদিবাসীদের ওপর জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর গণহত্যা চালাতে তাদের শিশুদেরকে স্কুলে জড় করত। দ্বিতীয় অপরাধযজ্ঞটি ছিল আরও বড়। আর তা করেছিল শিশুদের ওপর ভ্যাটিক্যান গির্জা। কানাডার আদিবাসী ওই শিশুদের ওপর নির্যাতনের কারণে পোপে ফ্রান্সিস ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন যখন ডে-নাইট স্কুলগুলোর প্রাঙ্গণে বা আশপাশে শত শত অচিহ্নিত কবর আবিষ্কার হয়।
কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এইসব স্কুলে স্থানীয় আদিবাসী শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে এই স্কুলগুলোর অস্তিত্বের শেষের দিকে তথা ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে। অর্থাৎ মার্কিন ও কানাডার সরকারগুলো যতই নিজেদের বেশি সভ্য ও বেশি মানব-দরদি বলে জাহির করছিল ততই তাদের মধ্যে বর্ণবাদী ও নিজেদের বড় ভাবার মানসিকতা বেড়ে গিয়েছিল। একজন সাবেক ক্যাথলিক পাদ্রি স্বীকার করেছেন যে যখন যৌন নিপীড়নের অভিযোগগুলো আসতে লাগল তখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এই স্কুলগুলো অপরাধীদের আজব রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
বন্ধ্যাকরণ ও দাস প্রথা
১৯৩০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী ও রেড-ইন্ডিয়ান বিষয়ক দপ্তর চিকিৎসা সেবার নামে রেড-ইন্ডিয়ান নারীদের বন্ধ্যাকরণ করত। অনেক সময় এ বিষয়ে তাদেরকে কিছুই জানানো হত না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১৯৭০-এর দশকে ৪২ শতাংশেরও বেশি রেড-ইন্ডিয়ান নারী সন্তান জন্মদানের বয়সেই বন্ধাত্যকরণের শিকার হয়েছেন।
খ্রিস্টিয় ১৬২৫ সাল থেকে ১৭৭৫ সালে আমেরিকার ১৩ টি উপনিবেশে জনসংখ্যা দুই হাজার থেকে বেড়ে ২৪ লাখে উন্নীত হয়। অথচ উত্তর-পূর্ব আমেরিকার আদিবাসীরা এ সময় গৃহহারা ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা পেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পর সেখানে অভিবাসনের স্রোত শুরু হয়। ইউরোপীয় অভিবাসীরা স্থানীয় অ্যাপাচি, চারুকি, শ'ইন, শিনুক, নাওয়াহু ও সিউক্সসহ নানা গোত্রের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে তাদের প্রজন্মকে বিলুপ্ত করে।
ডেভিড ই. স্ট্যানার্ড তার "আমেরিকান হলোকাস্ট: দ্য কনকয়েস্ট অফ দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড" বইতে এ মত প্রকাশ করেন যে পশ্চিম গোলার্ধের প্রায় দশ কোটি আদিবাসী জনগণ ইউরোপীয় অভিবাসী এবং তাদের বংশধরদের হাতে পাঁচ শতাব্দীর মধ্যে নিহত হয়েছিল। যদিও জীবন রক্ষার অধিকার, স্বাধীনতা ও সৌভাগ্যের কথাগুলো বলা হয়েছে মার্কিন স্বাধীনতার ইশতেহারে কিন্তু বাস্তবে আমেরিকার সব অধিবাসীর জন্য এসব অধিকার নেই ও ছিল না। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা বর্ণ-বৈষম্য ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকামিতার ওপরই প্রতিষ্ঠিত। শ্বেতাঙ্গরা এখানে এক নতুন দাসপ্রথা চালু করেছে। সপ্তদশ শতক থেকে বিংশ শতকে প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশুকে আফ্রিকা থেকে আনা হয় আমেরিকায়।
ট্র্যান্স-আটলান্টিক দাস ব্যবসা শীর্ষক ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী উত্তর আমেরিকায় নিয়ে-আসা এক কোটি ২৫ লাখ ব্যক্তিকে মুক্ত শ্রমিক হিসেবে আনা হলেও তাদেরকে অত্যন্ত কঠিন শ্রমসাধ্য কাজে ব্যবহার করা হত।