আবনা ডেস্ক:
খুতবা ১০০
এ খুতবাটি মহানবী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত প্রসঙ্গে
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি তাঁর কৃপা তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকুলে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের প্রতি তাঁর অবারিত দানের হস্ত প্রসারিত করে দিয়েছেন। আমরা তাঁর সকল কর্মকাণ্ডে তাঁরই প্রশংসা করি এবং আমরা যাতে (আমাদের ওপর) তাঁর অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় ও সংরক্ষণ করতে পারি সেজন্য তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। আমরা সাক্ষ্য প্রদান করি, তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ (উপাস্য) নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁরই বান্দা ও রাসূল। মহান আল্লাহ তাঁকে (বাতিল-মিথ্যার প্রাচীর) ধ্বংসকারী এবং তাঁর স্মরণ উজ্জীবনকারী হিসেবে তাঁর দীন (ঐশী আদেশ-নির্দেশ)সহ (মানব জাতির কাছে) প্রেরণ করেছেন। এরপর তিনি পূর্ণ নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে স্বীয় রিসালতের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং (সমগ্র জীবনব্যাপী) সুপথের ওপর অবিচল থেকেছেন। তিনি আমাদের মাঝে সত্যের পতাকা (আহলে বাইত) উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন। যারা এই সত্যের পতাকা ও নিশান থেকে অগ্রগামী হবে তারাই (দীন থেকে) খারিজ হয়ে যাবে; আর যারা এ থেকে পিছে পড়ে থাকবে তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে; আর যারা এর সাথে (সত্যের পতাকার সাথে) লেগে থাকবে (অর্থাৎ সত্য ও সত্যপন্থীদেরকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখবে) তারাই (সত্যের সাথে) থাকবে। সত্যের নিশানের সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে, তারা কথা বলার ক্ষেত্রে স্থির, প্রশান্ত, গভীর, ধীর স্থিরভাবে ও বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে (অর্থাৎ নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতার সাথে কাজ করে না এবং যখন সামর্থ্য অর্জিত হয় কেবল তখনই কাজ করে) আর তারা খুবই দ্রুত কর্ম সম্পাদন করে যখন কোন কাজ করার উদ্যোগ নেয়। যখন তোমরা তাঁর (মহানবী) সামনে তোমাদের গ্রীবাদেশ আনুগত্যের সাথে ঋজু করেছো এবং তাঁর দিকে তোমাদের অঙ্গুলি নির্দেশ করেছো ঠিক তখনই তাঁর কাছে মৃত্যু উপস্থিত হলো এবং তিনি পরপারে চলে গেলেন। অতঃপর এমন এক ব্যক্তি যিনি তোমাদেরকে সংঘবদ্ধ (করবেন) এবং তোমাদেরকে বিক্ষিপ্ততা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে একত্র করবেন তাকে বের করে আনা পর্যন্ত মহান আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন তোমরা বেঁচে রইলে। তাই যে সামনে এগিয়ে আসে না, তার ব্যাপারে অযথা কিছু প্রত্যাশা করো না আর যে পশ্চাতে গমন করে অর্থাৎ পেছনে ফিরে যায় তার প্রতিও নিরাশ হয়ো না। কারণ সম্ভবত পশ্চাতে গমনকারীর দু’পায়ের একটি স্খলিত ও স্থানচ্যুত হলেও অন্যটি অবিচল ও যথাস্থানেই স্থির থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না উভয় পা যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করে ঠিক হয়ে না দাঁড়ায়। জেনে রাখো, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের উপমা হচ্ছে আকাশের নক্ষত্রতুল্য। একটি নক্ষত্র অস্ত গেলে অন্য একটি উদিত হয়। তাই যেন তোমাদের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর নেয়ামতসমূহ পূর্ণতা লাভ করেছে এবং তোমরা যা চাইতে ও আকাংক্ষা করতে তিনি (আল্লাহ) তা তোমাদেরকে দেখিয়েছেন।
খুতবা ১০৪
নিশ্চয় মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এমন এক সময় প্রেরণ করেছিলেন যখন আরবের কোন ব্যক্তি না পড়তে পারত, আর না নবুওয়াত ও ওহীরও দাবী করত। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যারা তাঁর আনুগত্য করেছিল তাদের সাহায্যে, যারা তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেছিল তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। আর এভাবে তাদেরকে তাদের নাজাতস্থলে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং তাদের ওপর মৃত্যু অকস্মাৎ এসে পড়ার আগেই তাদেরকে অতি দ্রুত উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু ক্লান্ত-শ্রান্ত ব্যক্তি আরো ক্লান্ত ও দুর্বল হয়েছে আর দুর্বল আকীদা-বিশ্বাস পোষণকারী ব্যক্তিই মুমিনদের পথে পথ চলা থেকে থমকে দাঁড়িয়েছে এবং তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত যাত্রা বিরতির ওপরই বহাল থেকেছে। তার মধ্যে কোন মঙ্গল ও কল্যাণ নেই। পরিণামে তিনি তাদেরকে (পথহারা, বিপথগামী, পথভ্রষ্ট আরব জাতিকে) তাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, তাদের সবাইকে তাদের নিজ নিজ স্থানে সংস্থাপন করেছেন। আর এর ফলে তাদের জীবন চাকা সচল ও আবর্তিত (হয়েছে) [অর্থাৎ তাদের সার্বিক ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে এবং তাদের জীবিকায় প্রাচুর্য এসেছে] এবং তাদের সার্বিক অবস্থা ভালো এবং শক্তিশালী হয়েছে। মহান আল্লাহর শপথ, আমি ছিলাম সেই পর্যন্ত তাদের সৈন্যবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশের অন্তর্ভুক্ত রক্ষাকারী অতন্দ্র প্রহরী যে পর্যন্ত না তারা (আরব জাতি) [হেদায়েত ও ঈমানের পথে] সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে (একতা ও ঐক্যের) রজ্জুতে জমায়েত হয়েছিল (অর্থাৎ তারা ঈমানের দিকে ফিরে এসেছিল এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল)। আমি কখনো দুর্বলতাও দেখাইনি এবং কাপুরুষতাও প্রদর্শন করিনি। আর না আমি কখনো স্বীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে অলস ও শিথিল হয়েছি। মহান আল্লাহর শপথ, আমি অবশ্যই বাতিল-অসত্য অন্যায়কে চিরে ফেলে এর পাঁজর থেকে সত্যকে বের করে আনবোই।
খুতবা ১০৫ থেকে
মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন শৈশবে সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোত্তম এবং বয়স্কাবস্থায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র। তিনি ছিলেন স্বভাব-চরিত্রে সকল পবিত্র ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র। তিনি ছিলেন স্থায়ী ও অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘমালার মত দানশীলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (দানশীল) [অর্থাৎ যেসব মেঘ থেকে অবিরাম স্থায়ীভাবে বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকে সেসব মেঘের মত যারা স্থায়ীভাবে দান করে যায় তাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন।]
খুতবা ১০৬ থেকে
তিনি (হযরত মুহাম্মদ) সত্যের সন্ধানকারীদের জন্য (হেদায়েতের) অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন এবং পথহারা উষ্ট্র আবদ্ধকারী ব্যক্তিদের অর্থাৎ বিপথগামীদের জন্য আলোকবর্তিকা স্থাপন করেছিলেন (অর্থাৎ মরু প্রান্তরে পথহারা উষ্ট্রচালক দিশেহারা হয়ে স্বীয় উষ্ট্রী বেঁধে রাখে এবং জানেও না যে, কিভাবে সে পথ চলবে তাই সে পথ চলা ক্ষান্ত দেয়। তাই এদের জন্য পথ চলতে সহায়ক আলোকোজ্জ্বল পতাকা বা আলোকবর্তিকা স্থাপন করা হয় ঠিক তেমনি তিনি বিপথগামীদের পথের সন্ধান এবং সঠিক পথে চলার জন্য হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও পতাকা স্থাপন করেছিলেন)। তাই এ কারণেই তিনি আপনার একান্ত বিশ্বস্ত আমানতদার, শেষ বিচার
দিবসে আপনার সাক্ষী, নেয়ামতস্বরূপ আপনার প্রেরিত (নবী) এবং আপনার রহমতস্বরূপ সত্য রাসূল। হে আল্লাহ, আপনার আদালত অর্থাৎ ন্যায়-বিচার থেকে তাঁকে যথার্থ প্রাপ্য প্রদান করুন। আপনার অপার করুণা থেকে অগণিত কল্যাণ ও মঙ্গল দিয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করুন। হে আল্লাহ, সকল নির্মাতার (নির্মিত) ভবনসমূহের চেয়েও তাঁর ভবন বা ইমারতকে উঁচু করুন। আর আপনার কাছে তাঁর আগমনকে সম্মানিত করুন এবং আপনার কাছে তাঁর অবস্থানকে মর্যাদাপূর্ণ করে দিন। তাঁকে ওয়াসীলাহ্ দান করুন। তাঁকে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানে অধিষ্ঠিত করুন। আমাদেরকে তাঁর সাথে এমতাবস্থায় (কিয়ামত দিবসে) পুনরুজ্জীবিত করুন যাতে করে আমারা লজ্জিত, অনুতপ্ত, (সত্য থেকে) বিচ্যুত, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী, বিপথগামী, বিচ্যুতকারী ও প্রলোভিত না হই।
খুতবা ১০৮
মহান আল্লাহ তাঁকে [হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে] নবীদের পবিত্র বৃক্ষ থেকে, আলোর প্রদীপ থেকে, সুউচ্চ আকাশের মত মর্যাদা ও মহত্ত্বের শীর্ষদেশ থেকে, বাত্হা’র প্রাণকেন্দ্র (পবিত্র মক্কা) থেকে অন্ধকারের প্রদীপ এবং প্রজ্ঞার প্রস্রবণ ও উৎস থেকে নির্বাচিত ও মনোনীত করেছেন।
হযরত মুহাম্মদ ছিলেন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক যিনি রোগের উপশম দানকারী মলম প্রস্তত করে রাখতেন এবং ক্ষতস্থানে দাগ লাগানোর যন্ত্রকে উত্তপ্ত রাখতেন। যখনই অন্ধ হৃদয়, বধির কান ও বাকশক্তিহীন জিহ্বার চিকিৎসার প্রয়োজন হতো তখনই তিনি এগুলো (অর্থাৎ চিকিৎসার এসব উপায়-উপকরণ) দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতেন। তিনি অবহেলা-অমনোযোগ ও জটিলতার স্থানসমূহে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে (সঠিক) ঔষধ প্রয়োগ করতেন।
খুতবা ১০৯ থেকে
তিনি দুনিয়ার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন এবং একে অতি তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন মনে করতেন। তিনি জেনেছিলেন, মহান আল্লাহ ইচ্ছা করেই তাঁর নিকট থেকে দুনিয়াকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন এবং একে অবজ্ঞাকারে অন্যদের জন্য প্রশস্ত করেছেন। তাই তিনি মনে-প্রাণে এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং হৃদয় থেকে এর সকল স্মৃতিচিহ্ন ও স্মরণ মুছে ফেলেছিলেন যাতে করে এ দুনিয়া থেকে গর্ব ও গৌরবের কোন পোশাক তাঁর পরিধান করতে না হয় অথবা এ দুনিয়ায় তাঁর যেন কোন পদ মর্যাদা ও আসনের লোভ ও আশার সৃষ্টি না হয়। সেজন্য তিনি চাইতেন এবং কামনা করতেন যেন তাঁর দৃষ্টি থেকে এর সকল রূপ-রস ও সৌন্দর্য বিদূরিত ও বিলীন হয়ে যায়। তিনি তাঁর নিজ প্রভুর পক্ষ থেকে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন ও প্রচার করেছিলেন যা ছিল বান্দাদেরকে পাপের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের সকল অজুহাত ও ওজর-আপত্তি অপনোদনকারী। তিনি তাঁর উম্মাতকে সতর্ককারী হিসেবে সদুপদেশ দিয়েছিলেন এবং সুসংবাদদাতা হিসেবে তাদেরকে বেহেশতের দিকে আহবান করেছিলেন। আর ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে তাদেরকে নরকাগ্নির ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন।
মূল আরবী থেকে মোঃ মুনীর হোসেন খান কর্তৃক অনূদিত
(চলবে...)