ইমাম সাদিক (আলাইহিস সালাম) এর পবিত্র শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে হাওযা ইলমিয়্যাহ’র এ উস্তাদ কর্তৃক আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা আবনাকে দেয়া সাক্ষাতকারের কিয়দাংশ নিম্নে উল্লেখ করা হল:
আবনা : কেন শিয়া মাযহাবকে ‘জাফরী মাযহাব’ বলা হয়?
-বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
এ প্রশ্নের জন্য প্রসিদ্ধ একটি উত্তর দেয়া হয়ে থাকে, যা আমার দৃষ্টিতে সঠিক নয়। কিন্তু তবুও আমি সেটার প্রতি ইশারা করছি।
(এভাবে বলা হয় যে,) বনি উমাইয়া তাদের শাসনামলের শেষের দিকে অধঃপতনের শিকার হয় এবং তারা দূর্বল হয়ে পড়ে। বনি আব্বাসও তাদের যুগের প্রথমদিকে তেমন শক্তিশালী হয়ে উঠেনি এবং তারা সরকার গঠনের প্রাথমিক কার্যক্রম নিয়েই অধিক ব্যাস্ত ছিল। হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঐশি জ্ঞান প্রচারের শুরু করেন। আর এ কারণেই শিয়া মাযহাবকে ‘জাফরী মাযহাব’ হিসেবে নামকরণ করা হয়।
আমার দৃষ্টিতে উক্ত প্রশ্নের জন্য এ উত্তর যথাযথ ও সঠিক নয় এবং এটা একটি দূর্বল উত্তর, বলা যেতে পারে যে, এ উত্তরটি কোনভাবেই সঠিক নয়।
আবনা : তাহলে সঠিক উত্তর কোনটি?
- আমরা বানি উমাইয়া সরকারকে এমনকি হযরত ইমাম বাকির (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এর যুগেও শক্তিশালী একটি সরকার রূপে চিনি। বনি উমাইয়া সরকারের শাসনামলের শেষ সময় পর্যন্ত সহিংসতা, অত্যাচার ও স্বৈরচারীতা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ তারা তাদের হুকুমতের শেষের দিকেও তেমনভাবে দূর্বল হয়ে পড়েনি। আর তাছাড়া ‘আব্দুল মালেক’ নামধারী শাসকগণ ও ‘ওয়ালিদ নামধারী শাসকদের ক্ষেত্রে এ কথা আদৌ মানায় না যে, তারা দূর্বল শাসক ছিল। তারা চরম সহিংসতা, অত্যাচার, স্বৈরচারিতার মাধ্যমে হুকুমত করতো। অতএব, অন্যভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি দিলে উল্লিখিত উত্তরের চেয়ে সঠিক উত্তর আমাদের হস্তগত হয়। এ বিষয়টি ‘হযরত মহানবী (স.) এর সুন্নত (হাদীস) লিপিবদ্ধ করণের’ বিষয়ের প্রতিই প্রত্যাবর্তন করে। আপনারা অবগত যে, প্রথম খলিফার (আবু বকর) যুগ হতে আল্লাহর রাসূল (স.) এর হাদীস লিপিবদ্ধ ও বর্ণনার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আর এ নিষেধাজ্ঞা ‘উমর বিন আব্দুল আযিযে’র যুগ অবধি অর্থাৎ তার পূর্বেকার অন্যান্য খলিফার যুগেও প্রযোজ্য ছিল। এ ক্ষেত্রে কাউকে তাঁর (স.) হতে বর্ণিত হাদীস লেখা প্রচারের অনুমতি দেয়া হত না। ইবনে কাসির দামেস্কি তার ‘আল বেদায়াহ ওয়ান নেহায়াহ’ গ্রন্থে আয়েশা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: ‘আমার পিতা আবু বকর, হযরত মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৫০০টি হাদীস আমাকে দিয়ে তা তুলে রাখতে বললেন। (অতঃপর) একরাতে আমার পিতাকে দেখলাম তিনি খুবই উদ্বিগ্ন ও নির্ঘুম অবস্থায় রাত কাটাচ্ছেন। সকাল হলে তিনি আমাকে ডেকে বললেন: হে কন্যা! তোমাকে যে হাদীসগুলো দিয়েছিলাম সেগুলো আমাকে দাও। আমি যখন উক্ত হাদীসগুলো তাকে দিলাম, তিনি আগুন চাইলেন এবং সেগুলোকে জ্বালিয়ে দিলেন’। (!)
অপর এক রাবী (বর্ণনকারী) বলেছেন: উমর ইবনে খাত্তাব আমাদেরকে ইরাকে প্রেরণের সময় বললেন: সেখানে গিয়ে আল্লাহর নবী (স.) এর হাদীস লিপিবদ্ধ ও বর্ণনা করো না! তিনি এ সময় আমাদেরকে সতর্ক করে (হুমকি) দিয়ে আমাদেরকে বোঝান যে, বানি সায়াদার খেলাফতের নীতিকে অব্যাহত রাখতে হবে।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর হাদীস লিপিবদ্ধ, বর্ণনা ও প্রচার না করার নীতিটি খলিফাদের মাযহাবের অতি প্রসিদ্ধ একটি নীতি।
উক্ত নীতি অবলম্বনের ফলে যা মুসলমানদের ভাগ্যে জুটেছিল তা হচ্ছে, ইবনে হাজার আসকালানী’র মতে ১২০ বছর এবং গাজালী’র মতে ১৪০ বছর আল্লাহর রাসূল (স.) এর হাদীস লিপিবদ্ধ করণের উপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকে।
উমর বিন আব্দুল আযিয উক্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর সমগ্র ইসলামি রাষ্ট্রে ঘোষণা করে দেয়া হয় যে, মহানবী (স.) হতে বর্ণিত হাদীস লিপিবদ্ধ করা যায়েজ ও মুবাহ। উক্ত ঘোষণার পর আহলে সুন্নতের অনুসারীদের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। কেননা তারা যখনই চাইতো মহানবী (স.) এর হাদীস বর্ণনা করতে ও লিপিবদ্ধ করতে, তখন তাদের মাঝে এমন কেউ ছিল না যে, তাঁর (স.) হতে বর্ণিত হাদীস সমূহ মুসলমানদের জন্য বর্ণনা করবে। মহানবী (স.) এর সাহাবীদের কেউ কেউ শহীদ হয়েছিলেন এবং অনেকে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছিলেন। সুতরাং হাদীস বর্ণনা ও লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাদের সম্মুখে দু’টির বেশি রাস্তা খোলা ছিল না।
(উক্ত রাস্তা দু’টি হচ্ছে:)
(ক) হাদীস জাল করা (অন্য ভাষায় হাদীস তৈরী করা)।
(খ) মহানবী (স.) এর আহলে বাইত (আ.) হতে হাদীস গ্রহণ করা।
প্রথম পদ্ধতিতে, রাবীগণ এবং যারা নিজেদেরকে মোহাদ্দেস হিসেবে মনে করত (যেমন: আবু হোরায়রা) তারা হাদীস তৈরীর কার্যক্রম শুরু করে দেয়। ‘আল ইমাম সাদিক (আ.)’ গ্রন্থে ‘আসাদ হায়দার’ সুন্নি মাযহাবের গ্রন্থ হতে বর্ণনা করেছেন যে, একদা বনি আব্বাসের একজন খলিফা সভাসদদের নিয়ে দরবারের বসেছিল। এমন সময় হাদীস জালকারী এক মোহাদ্দেস দরবারে প্রবেশ করলো। খলিফা তাকে জিজ্ঞেস করলো: তুমি কি মহানবী (স.) হতে একটি হাদীস আমাদের জন্য বর্ণনা করতে পারো?
মিথ্যাবাদী ঐ মোহাদ্দেস বললো: মহানবী (স.) বলেছেন: আমি চারটি জিনিসকে ভালবাসি। (যদিও প্রসিদ্ধ এ হাদীসটিতে তিনি (স.) বলেছেন: আমি তিনটি জিনিসকে পছন্দ করি; কিন্তু মিথ্যাবাদী ঐ হাদীস জালকারী লোকটি আব্বাসী খলিফার দরবারের বললো, তিনি (স.) বলেছেন আমি চারটি জিনিসকে পছন্দ করি) ঐ চতুর্থ জিনিসটি হল: কবুতর নিয়ে খেলা করা!! অর্থাৎ মহানবী (স.) একথা বলেছেন যে, যারা কবুতর প্রতিপালন করে ও কবুতরবাজী করে আমি তাদেরকে পছন্দ করি (নাউজুবিল্লাহ)।
খলিফা মিথ্যাবাদী উক্ত হাদীস জালকারীকে সেদিন পুরস্কারও দিয়েছিল। মিথ্যাবাদী লোকটি দরবার ত্যাগ করার পর, খলিফা উপস্থিত সভাসদদের উদ্দেশ্যে বললো: আল্লাহর কসম এ (কথিত) মোহাদ্দেস মিথ্যা বলেছে এবং মহানবী (স.) এর সাথে একটি মিথ্যা বিষয়কে সম্পৃক্ত করেছে (অর্থাৎ মহানবী (স.) এর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে)। কেননা মহানবী (স.) এর হাদীসে তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এ (কথিত) মোহাদ্দেস জানে যে আমি কবুতর ভালবাসী তাই আমাকে সন্তুষ্ট করতে মহানবী (স.) এর উপর এ মিথ্যা অপবাদ সে আরোপ করেছে’!
আবনা : আবু হুরাইরা সম্পর্কে কিছু বলুন।
- আবু হুরাইরা হাদীস জালকারীদের মাঝে প্রসিদ্ধ এক ব্যক্তিত্