‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : Pars Today
সোমবার

২৬ আগস্ট ২০১৯

৪:০২:২৩ AM
971595

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টির কারণ ও এর পরিণতি: পর্ব-দুই

ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের যে পরমাণু সমঝোতা সই হয়েছে ব্রিটেন তার অন্যতম শরীক দেশ। আমেরিকা পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ব্রিটেন এর নিন্দা জানালেও বাস্তবে লন্ডন ওয়াশিংটনের তেহরান বিরোধী কর্মকাণ্ডের সহযোগী ও সমর্থক।

(ABNA24.com)  ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের যে পরমাণু সমঝোতা সই হয়েছে ব্রিটেন তার অন্যতম শরীক দেশ। আমেরিকা পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ব্রিটেন এর নিন্দা জানালেও বাস্তবে লন্ডন ওয়াশিংটনের তেহরান বিরোধী কর্মকাণ্ডের সহযোগী ও সমর্থক।

মার্কিন নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই ব্রিটেন জিব্রাল্টার প্রণালীতে বেআইনিভাবে ইরানের একটি তেলবাহী জাহাজ আটক করে। ব্রিটেন দাবি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওই জাহাজ সিরিয়ার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল বলেই এটাকে আটক করা হয়। এর কিছুদিন পর গত ২০ জুলাই ব্রিটেনের একটি তেলবাহী জাহাজ 'স্টেনা ইম্পেরো' আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ভঙ্গ করে হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করার সময় ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী  বা আইআরজিসি'র নৌ বাহিনী সেটাকে আটক করে। ইরানের পাল্টা পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্রিটেনও ইরানকে ভয় দেখানোর জন্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ডেস্ট্রয়ার পাঠায়। ইরান ভয় না পেলেও ব্রিটেনের এ পদক্ষেপে এ অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়।

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির বিষয়টিকে কয়েকটি দিক থেকে মূল্যায়ন করা যায়। প্রথমত, ব্রিটেনের অংশগ্রহণে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে সীমিত পর্যায়ে যুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুদ্ধ একবার শুরু হলে তা আর সীমিত পর্যায়ে থাকবে না বরং ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে। ইরানের সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন অত্যাধুনিক ড্রোন ভূপাতিত করার পর পরিস্থিতি যুদ্ধের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল যদিও যুদ্ধের আশঙ্কা ছিল খুবই ক্ষীণ। কারণ মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করে ইরান একদিকে নিজের শক্তিমত্বা তুলে ধরেছে এবং অন্যদিকে প্রতিপক্ষকে দেখিয়ে দিয়েছে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। অর্থাৎ ইরানকে মোকাবেলা করতে এলে আমেরিকা ও তার মিত্রদেরকে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেন থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো সূত্রে জানা গেছে ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমিরাতের একটি প্রতিনিধি দল তেহরানে এসেছে এবং এ অঞ্চলে উত্তেজনা কমিয়ে আনার জন্য ইরানের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে।       

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ভাল করেই জানেন ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ হবে অনেক ব্যয়বহুল, ভয়াবহ এবং তা হবে দীর্ঘ মেয়াদি লড়াই। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধে জড়ালে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভরাডুবি হতে পারে বলে ট্রাম্পের আশঙ্কা। অন্যদিকে ইরানও বহুবার বলেছে, তারা কখনোই যুদ্ধ শুরু করবে না। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে আপাতত যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

রাশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা আনাতোলি তাসিগানোক মনে করেন, "ইরান ও আমেরিকার মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ এবং ওয়াশিংটন ও তেহরান ভাল করেই জানে যেকোনো সামরিক সংঘাত শুরু হলে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ ছাড়া, ইরান ইরাক নয় এবং ইরানের রয়েছে আট কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যা। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ইরানের রয়েছে শক্তিশালী ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। তাই যুদ্ধ বাধলে শুধু আমেরিকা নয় তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোও আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই বলা যায় আপাতত ইরান-মার্কিন যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই।"

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, বিরাজমান উত্তেজনা নিরসনে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আব্দুল মাহদি এবং ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউসুফ বিন আলাভি মধ্যস্থতার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে সফলতার বিষয়টি নির্ভর করছে ইরানের ব্যাপারে আমেরিকা ও ব্রিটেনের  বিদ্বেষী নীতি পরিবর্তনের ওপর। উত্তেজনা নিরসনের লক্ষ্যে ওই দুই কর্মকর্তার ইরান সফরের পর আমেরিকা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ থেকে বোঝা যায় ওয়াশিংটন এখনো ইরানের ব্যাপারে বিদ্বেষী নীতি ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়। এ অবস্থায় ইরান-মার্কিন উত্তেজনা হ্রাস এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসনের আশা করা যায় না।

ইরান-মার্কিন উত্তেজনা হ্রাসে তৃতীয় পথ হচ্ছে আলোচনা প্রক্রিয়া। ইরান ও ব্রিটেনের মধ্যে যেকোনো বিষয়ে সংলাপ হতে পারে। এমনকি দুই দেশের হাতে আটক একে অপরের তেলবাহী জাহাজ ছাড়িয়ে নেয়া ও এ ব্যাপারে উত্তেজনা হ্রাসের বিষয়েও হয়তো একটা সমঝোতা হবে। কিন্তু আমেরিকা বারবার ইরানের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও ওয়াশিংটনের সঙ্গে তেহরানের সংলাপে বসার কোনোই সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে আমেরিকা পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আরো দূরত্ব ও অনাস্থা বেড়েছে। গত ১৫ মাসে আমেরিকার ইরান বিরোধী তৎপরতা অনাস্থার মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলেছে। অন্যদিকে, আমেরিকা চায় ইরানের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু ইরান এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেছে, জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা প্রশ্নে তেহরান কোনো আপোষ করবে না।

বাস্তবতা হচ্ছে, ইরান আমেরিকার অত্যাধুনিক ড্রোন ভূপাতিত করে নিজের শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। ইরান এও প্রমাণ করেছে তারা শত্রুদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাখে। তাই আমেরিকার হুমকিতে ইরান মোটেও ভীত নয়।

চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে, বর্তমানে হরমুজ প্রণালীতে ইরানের সঙ্গে আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং ইরানের সঙ্গে তাদের বাকযুদ্ধ চলছে। আগামীতে এ উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ মার্কিন সরকারের ইরান বিদ্বেষ অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞাই এর প্রমাণ। অন্যদিকে, তেলবাহী জাহাজ নিয়ে ইরান ও ব্রিটেনের মধ্যেও উত্তেজনা চলার মধ্যে লন্ডন ও ওয়াশিংটন হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তার অজুহাতে সামরিক জোট গঠনের প্রস্তাব দেয়ায় উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে।

এ ছাড়া, বর্তমানে ইউরোপের তিনটি প্রভাবশালী দেশ পরমাণু সমঝোতা বাস্তবায়ন না করলেও তারা এ চুক্তিতে ইরানকে ধরে রাখার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানি এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তারা সর্বনিম্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইরানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় অর্থ লেনদেন বিষয়ক ইন্সটেক্স ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দিলেও আজো তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণেও ইরানও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। বলা যায়, ইউরোপের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এ অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। #




/129