আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা)-র নিজস্ব প্রতিবেদক: মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম একটি আরব দেশ হল কুয়েত। দেশটি পারস্য উপসাগরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। স্থল সীমায় ইরাক ও সৌদি আরবের সাথে এবং জলসীমায় পারস্য উপসাগরের মাধ্যমে ইরানের সাথে সীমানা রয়েছে দেশটির। দেশটির রাজধানীর নাম ‘কুয়েত সিটি’। দেশটির প্রায় ৩৫% মানুষ শিয়া মাজহাবের অনুসারী হওয়ায় দেশটির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে শিয়াদের বিশেষ আধিপত্য রয়েছে।
কুয়েতের শিয়ারা মূলতঃ অভিবাসনের মাধ্যমে দেশটিতে নিজেদের বসতি গড়ে তুলেছে। কুয়েতের শিয়া জনগোষ্ঠির বেশিরভাগ সাধারণত ইরান, ইরাক, সৌদি আরব বা বাহরাইনী বংশোদ্ভূত। ইরানী বংশোদ্ভূত শিয়াদেরকে আঞ্চলিক পরিভাষায় “আজামে কুয়েতি” নামে প্রসিদ্ধি রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় সমুদ্র উপকূলবর্তী বিভিন্ন প্রদেশ এবং বু-শাহর, ফার্স ও খুজেস্তানের মত প্রদেশ থেকে এদেশে এসেছে। বেশিরভাগ ইরাকি শিয়ারা ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল বসরা, নাজাফ এবং কারবালা থেকে। সৌদি শিয়ারা পূর্বাঞ্চল এবং আহসা থেকে এসেছে। বাহরাইন থেকে আগত শিয়ারা বাহারানাহ এবং কালালিফ নামে পরিচিত। এসব অভিবাসন মূলতঃ নিজেদের ব্যবসা ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিসহ বিভিন্ন কারণে সংঘটিত হয়েছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর প্রণীত কুয়েতের সংবিধান, শিয়াদেরকে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার দান করে। দেশটির সরকার মাজহাবের প্রচলিত রীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, জন-শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করে না এবং সমাজের রীতিনীতির বিরোধী নয় এমন সকল ধর্মীয় কার্যক্রমকে সমর্থন করে থাকে।
কুয়েতের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অবদান রাখা বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কতিপয় শিয়া পরিবারের অবস্থান রয়েছে। এই পরিবারের মধ্যে সুপরিচিত নাম হল আল-ওয্যান, বেহবাহানী ও দাশতী। এছাড়াও, শিয়ারা নিজেদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ থেকে উপকৃত হয়েছে। কুয়েত সরকার শিয়া ও সুন্নি সবার জন্য বিনামূল্যের শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখান থেকে সকলেই সমানভাবে উপকৃত হয়ে থাকে।
নিম্নে আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থার সাধারণ পরিষদের কুয়েতি সদস্য “আবদুল্লাহ ঈসা ফিরোজ” -এর একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হল:
______________________________
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: আলী আনসার শাহরী
______________________________
আবনা: অনুগ্রহ পূর্বক শুরুতেই নিজের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবেন।
-আমি কুয়েতের অধিবাসী হাজ্ব আব্দুল্লাহ ঈসা ফিরোজ। পঞ্চাশ বছর পূর্বে আমেরিকার একটি প্রকৌশলী কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছি এবং বর্তমানে কুয়েতের পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে অবসরপ্রাপ্ত। আমি বিবাহিত এবং আমার চার পুত্র এবং চার কন্যা সন্তান রয়েছে।
আবনা: কুয়েতে আপনি কিরূপ সাংস্কৃতিক ও প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন?
-আলহামদুলিল্লাহ, আমি যুবক বয়স থেকেই ইমাম বারগাহে’র পরিবেশে বড় হয়েছি এবং আহলে বাইত (আ.)-এর ভালবাসা আমার অন্তরে গাঁথা। আমি আবা আব্দিল্লাহ আল-হুসাইন (আ.) ও আহলে বাইত (আ.) -এর পথের একজন অনুসারী, এতে রয়েছে আমার মায়ের বিশেষ চেষ্টা ও তার তরবিয়্যত। স্নাতক শেষ করার পর, আমি যুবকদেরকে সময় দিতে শুরু করি। কুয়েতের মসজিদগুলোয় তাদের গ্রুপ স্টাডিতে উপস্থিত হতে থাকি। এদেশের মসজিদগুলোতে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিশু-কিশোর ও যুবকদের জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক লেভেলের গ্রুপ স্টাডির সুযোগ রয়েছে। এই গ্রুপ স্টাডিতে মূলত আকাইদ, আখলাক, আহলে বাইত (আ.)-এর জীবনী পড়া হয়ে থাকে। কুয়েতের প্রতিটি মসজিদেই কমবেশি এমন সাংস্কৃতিক ও ইসলামী কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।
বলা যায়, কুয়েতের শিয়া সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালোর দিকে। এদেশীয় শিয়া যুবকদেরকে আমি বলেছি, তোমাদের সুযোগ সুবিধা আমাদের দুই তিন দশকের তুলনায় অনেক ভালো। কেননা ঐ সময় সুযোগ সুবিধা অনেক কম ছিল কিন্তু এখন সব কিছুই হাতের নাগালে। শিয়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বদৌলতে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।
আবনা: কুয়েতে শিয়াদের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন?
-কুয়েতের শিয়াসহ সকল সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ স্বাধীনতা উপভোগ করে থাকে। এক্ষেত্রে দেশটি পারস্য উপসাগরীয় অন্যান্য আরব দেশগুলির চাইতে ভিন্ন। কুয়েত সরকার ৬০’র দশক থেকে দেশটির রাজনীতিকে নব দ্বার উন্মোচন করে জনগণকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দান করেছে। এটিই মূলতঃ পারস্য উপসাগরীয় অন্যান্য আরব দেশগুলি থেকে কুয়েতকে পৃথক করেছে।
আবনা: কুয়েতের মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ শিয়া?
-সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশের ১৫% নাগরিক শিয়া। কিন্তু কুয়েতের শিয়ারা দাবি করে তারা মোট জনসংখ্যার ২৫%। অবশ্য আগে কুয়েতে শিয়াদেরকে মোট জনসংখ্যার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বলা হত, কিন্তু দেশটিতে জনসংখ্যার গঠনগত পরিবর্তনের কারণে কুয়েতের মোট জনসংখ্যার তুলনায় শিয়াদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে। এই পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল কুয়েতের সরকার ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় শঙ্কিত ছিল যাতে এই বিপ্লবের প্রভাব তাদের দেশের শিয়াদের মধ্যে প্রকাশ না পায়। তাই তারা দেশটির শিয়াদের মধ্যে নানা ধরনের পরিবর্তন কর্মসূচি হাতে নেয়।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিশ্বের সকল শিয়াদের অন্তরকে আনন্দিত করেছে। অপরদিকে কয়েকটি দেশের জন্য ভীতির কারণও হয়েছে। ইসলামী বিপ্লব ছিল একটি জন আন্দোলন যা ইরানের জনগণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং বিজয় অর্জন করে। এই বিপ্লবের ফলে যে শুধু সামরিক পরিবর্তন হয়েছে তা নয় বরং ফিলিস্তিনের জনগণকে সাহায্য করা এবং যায়নবাদী ইসরাইলের সাথে মোকাবেলা করার আশাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবনা: কিভাবে আহলে বাইত (আ.)-এর চিন্তাধারার প্রচার-প্রসার ঘটানো সম্ভব?
-শিয়াদের ধরন এমন যে তারা নিজেরা কারো কাছে পৌঁছায় না বরং অন্যরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, কুয়েতে সামাজিক কর্মকাণ্ডে শিয়া নাগরিকদের সাহসী অংশগ্রহণ ও কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাদেরকে অন্যদের তুলনায় সুখ্যাতি দান করেছে।
আবনা: কুয়েতের শিয়াদের সাথে অন্য মাজহাবগুলোর সম্পর্ক কেমন?
-কুয়েতে বিভিন্ন মাজহাব একত্রিত হয়ে একটি পারিবারিক সম্পর্কের সৃষ্টি করেছে। অনেক আগ থেকেই আহলে সুন্নতের অনুসারী এমনকি তাদের ওলামা ও রাজ পরিবারের সদস্যগণকে শিয়াদের ইমাম বারগাহে উপস্থিত হতে দেখা গেছে।
যদি কোন সমাজে ঐক্য থাকে এবং তাদের মধ্যে কোন সংকটের সৃষ্টি হয় তবে সংকট উত্তরণের পর পূর্বের ঐক্যকে পুনরায় স্মরণ করে নতুন করে নিজেদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করবে।
আবনা: জনাব আব্দুল্লাহ ঈসা ফিরোজ, আমাদের আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
-আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।