‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ABNA
সোমবার

৫ জুন ২০২৩

৭:১৬:৪৩ AM
1371203

শরীয়তমাদারের সাক্ষাতকার;

কষ্টের মাঝে থাকলেও আফ্রিকানরা প্রতিভাবান এবং দ্বীন ও আহলে বাইতকে (আ.) ভালবাসে

মুসলিম বিশ্বে এমনও অনেক অজানা বিষয় ও ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলির প্রতি মনোযোগ একজন ধর্মের প্রতি নিবেদিত ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী সাব্যস্ত হতে পারে হতে পারে।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): আফ্রিকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য এবং মুসলমান, মুহিব্বে আহলে বাইত ও আফ্রিকান শিয়াদের প্রতিভা সম্বন্ধে অবগতি লাভ, এমন এক পটভূমি তৈরি করে যা সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়ন এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য একাধিক প্লাটফর্ম তৈরিতে, কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে বার্তা সংস্থা আবনা প্রতিবেদক, বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেলের উপদেষ্টা এবং আরব-আফ্রিকান বিভাগের পরিচালক ডক্টর মোহাম্মদ মাহদি শারীয়তমাদারের সাথে আলাপকালে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চায়।

ডক্টর শরীয়তমাদার শুরুতেই এই মহাদেশে ইসলাম ও তাশাইয়্যুর আগমনের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন: আফ্রিকা মহাদেশ বিশেষ গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকা; যা ছিল ইসলামের সাথে যোগাযোগ স্থাপনকারী ও ইসলামের দাওয়াতে সাড়া দেয়া প্রথম অঞ্চল। মুসলমানদের প্রথম হিজরত হয়েছিল তৎকালীন হাবাশায়, যা আজকের ইথিওপিয়ায়, যে ঘটনা ও ইতিহাস সবারই জানা। ইমামগণ (আ.) -এর সময়েও এই অঞ্চলের কিছু লোক মাসুমীন (আ.) এবং মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। আফ্রিকাতে, বিশেষ করে এই অঞ্চলে ইসলামের উপস্থিতির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই দেশগুলির অধিকাংশ জনগণ খ্রিস্টান ধর্মকে অনুসারী; আর এটি সম্ভব হয়েছে মূলতঃ খ্রিস্টান চার্চসমূহ ও ধর্মীয় মিশনারিদের প্রচেষ্টার পাশাপাশি এই অঞ্চলে পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের উপস্থিতির কারণে।

আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে শিয়া চিন্তাধারার দ্রুত প্রবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: এই অঞ্চলে আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীদের উপস্থিতিরও দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতির প্রথম ঢেউটি শুরু হয় শিরাজিদের আগমনের মাধ্যমে; বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়া, জাঞ্জিবার এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে। পরবর্তীতে, ভারত থেকে চাপের মুখে ও মৃত্যুর হুমকি থেকে পলায়ন করে বারো ইমামীয়া খোজা শিয়াদের একটি দল এ অঞ্চলে অভিবাসী হয়, আর আজ আমরা এই অঞ্চলে খোজাদের শক্তিশালী উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি; যারা এই অঞ্চলে ইসলাম ও শিয়া মাজহাব প্রসারের কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়। তৃতীয় ঢেউটি শুরু হয় ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এবং এর প্রভাবের মধ্য দিয়ে। শুধু এই অঞ্চলেই নয়, অন্যান্য অঞ্চলেও আমরা ইসলাম ও শিয়া মাজহাব এবং ইসলামি বিপ্লবের সার্বভৌমত্ব বিরোধী উপাদানসমূহের বিরুদ্ধে অবস্থানের প্রতি মানুষের ঝোঁক প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব, এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের অধিকারী।

এই মহাদেশের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে শারীয়তমাদার বলেন: হর্ন অব আফ্রিকার গুরুত্ব, ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর ও বাব আল-মান্দাব প্রণালীর পাশে এ প্রদেশের অবস্থান এবং সেখান থেকে সুয়েজ খাল পর্যন্ত যাতায়াত ব্যবস্থা -এ বিষয়গুলির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় এই অঞ্চলের গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। কিন্তু ইতিহাস জুড়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার ফলে আমরা এ সব এলাকায় চরম দারিদ্র্য, শ্রেণী বৈষম্য এবং ইসলাম ও শিয়া সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জনগণের দুর্বলতার ন্যায় নানা সমস্যা প্রত্যক্ষ করেছি। আহলে বাইতের অনুসারীদের অনেকে, বিশেষ করে স্থানীয় অধিবাসীরা অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক দারিদ্র্য এবং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত দারিদ্রে ভুগছে। খোজারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও স্থানীয় শিয়া এবং মুসলমানরা সাধারণত দরিদ্র ও অল্প শিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষার সুযোগের অভাবে জর্জরিত। এই অঞ্চলে বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা নেই; শিক্ষার জন্য মোটা অঙ্কের টিউশন ফি এবং ভারী খরচ ব্যয় করতে হয়। আমরা দেখছি মুসলমান ও শিয়া যুবকদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। উদাহরণস্বরূপ, কয়েক হাজার লোকের একটি সমাজে; যাদের সত্তর শতাংশেরও বেশি তরুণ, মাত্র দশজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভ করে থাকে; তাও আবার অর্নাস পর্যায়ে।

আহলে বাইত বিশ্ব সংস্থার আরব-আফ্রিকান বিভাগের মহাপরিচালক, এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচারের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিয়ে বলেন: মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামি প্রতিষ্ঠান এবং মুবাল্লিগদের উপস্থিতি সত্ত্বেও, বিশেষ করে তানজানিয়া এবং দারুসালামের মতো কিছু কিছু এলাকায় যেখানকার মাদ্রাসাগুলি আরও সমৃদ্ধ, সেখানে মুসলমান এবং শিয়াদের ধর্মীয় ও ইসলামী সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এই অঞ্চলে আমাদের ইসলামি গণমাধ্যমের অভাব রয়েছে; শুধুমাত্র মাদাগাস্কারের একটি রেডিও স্টেশন, তানজানিয়ার একটি রেডিও এবং টেলিভিশন স্টেশন রয়েছে, যেগুলোর প্রভাব এবং ভৌগলিক কভারেজের পরিমাণ ও এর প্রভাবের বিষয়টি পর্যালোচনা করা উচিত। বাকি দেশগুলোতে প্রিন্ট মিডিয়ার পর্যায়েও আমাদের কোন ইসলামী মিডিয়া নেই। তবে অনলাইন এবং সামাজিক মাধ্যমগুলিতে মুসলমান, মুবাল্লিগ এবং ইসলামিক ব্যক্তিত্বদের তুলনামূলক ভাল উপস্থিতি রয়েছে। কখনো কখনো আমরা অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ ও অন্যান্য বিষয়বস্তু প্রচার হতে দেখি, কিন্তু এগুলি পরিপূর্ণভাবে চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আফ্রিকার প্রায় ষাট শতাংশ অঞ্চল ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের আওতাধীন অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের;  কিন্তু দরিদ্রতা ও ইন্টারনেটের উচ্চ মূল্যের মত নানা সমস্যার কারণে, সাধারণ জনগণ অনলাইনের ব্যাপক ব্যবহার হতে বঞ্চিত। যদিও এই ক্ষেত্রে প্রযোজনা এবং প্রচারণা রয়েছে; কিন্তু এর ব্যবহার সবার জন্য সম্ভব নয়।

শরীয়তমাদার যুক্ত করেন: অনেক মসজিদ এবং ইমামবাড়ায় নূন্যতম সুবিধার ব্যবস্থাও নেই; অবশ্য, কিছু জায়গার অবস্থা ভাল। যেমনটি বলা হল, উগান্ডায় শিয়াদের প্রায় ১৭০ থেকে ১৮০টি মসজিদ রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য মাজহাবের মসজিদও। কিন্তু আমরা যে মসজিদগুলো পরিদর্শন করেছি সেগুলো ছিল সুপরিচিত মসজিদগুলোর অন্যতম; সেখানে এমনকি একটি ভালো মাদুরের ব্যবস্থাও ছিল না। কিছু কিছু মসজিদে ছেড়া চাটাই বা ছেড়া কার্পেট বিছানো দেখেছি আবার কোনটায় তাও ছিলনা। এমন কিছু মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা এবং ছাত্রাবাসের সুব্যবস্থাও নেই। বাড়ি থেকে মাদ্রাসার দূরত্ব বেশী হওয়ায় ছাত্ররা ছাত্রাবাস ব্যবহার করতে বাধ্য। আবার কিছু কিছু জায়গায় দেখলাম, গাছের ডাল দিয়ে খাট তৈরি করে তা ব্যবহার করছে এবং শিক্ষার্থীরা আলো ছাড়াই ন্যূনতম সুবিধা নিয়ে অন্ধকারে দিনাতিপাত করছে। মুসলমানরাসহ মাদাগাস্কারের অনেক মানুষই নদী, পুকুর বা হ্রদের পাশে অত্যন্ত প্রতিকূল ও আর্দ্র পরিবেশে কাঠ বা টিনের তৈরি তিন, চার বা পাঁচ মিটারের ঘরে বসবাস করছে।

এটি কোন ব্যতিক্রমী বিষয় নয়, বরং মাদাগাস্কারের রাজধানীতেও এরূপ কয়েক মিটারের টিনের ঘরের সংখ্যা অনেক। এমনকি যে বাড়িগুলির আয়তন একটু বড়, সে বাড়িগুলোতেও টয়লেট ও গোসলখানা নেই এবং পরিবারের সদস্যদেরকে পাবলিক বাথরুম ও টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। মাদাগাস্কারের রাজধানী, যেখানে ফরাসি উপনিবেশ ছিল; ফরাসি ঔপনিবেশিকতা স্বাভাবিকভাবেই সেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির চিহ্ন থাকা উচিত ছিল, কিন্তু আমরা শহরের বাসিন্দাদেরকে নদীর কাদাটে ময়লা পানিতে কাপড় ধুতে দেখেছি। এটি রাজধানী মাদাগাস্কারের সর্বত্র চোখে পড়ে।

আহলে বাইত (আ.)-এর দ্বীন ও শিক্ষার প্রতি মানুষের অনুরক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন:

এমন দুরবস্থা এবং এই সকল সমস্যার মধ্যেও তারা ধর্মীয় ও ইসলামি বিষয়াদির প্রতি মনোযোগী; ফরজ আদায় এবং পবিত্র ইমামগণের (আ.) প্রতি যত্নবান। উদাহরণস্বরূপ, একটি মেয়েদের মাদ্রাসার ছাত্রীদেরকে সম্মিলিতভাবে ইমাম জামান (আ.) সম্পর্কে আরবি এমনকি ফার্সি ভাষায় কবিতা পাঠ করতে দেখলাম। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, ইসলামী বিপ্লব, ইমাম খোমেনী (রহ.) এবং সর্বোচ্চ নেতার প্রতি মুসলমান ও শিয়াদের অসাধারণ আগ্রহ ছিল সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট; যা সত্যিই অনন্য।

এটা অবিশ্বাস্য যে, এই দেশগুলির সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে, প্রত্যন্ত বনাঞ্চলগুলোতে -যেখানে আমাদের পৌঁছানোর জন্য কখনও কখনও নোংরা, পাথুরে এবং গর্তযুক্ত রাস্তায় দুই ঘণ্টা ভ্রমণ করতে হয়েছিল- আমরা লোকদের ফার্সি ভাষায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংগীত গাইতে দেখব। বাস্তবিক অর্থে একত্রে "সালাম ফারমান্দেহ" বা "সালাম ইয়া মাহদী"-এর মত সংগীত গাইতে দেখাটা এই দেশগুলির মধ্যে একটি অবাক করা ঘটনা বলা যেতে পারে।

চরম, অসহনীয় এবং অবিশ্বাস্য দরিদ্রতা থাকা সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি মনোযোগ ইসলাম, শিয়া মাজহাব এবং পবিত্র ইমামগণের (আ.) প্রতি ভালবাসা, এমনকি ইরানের প্রতি ভালোবাসা আমাদের জন্য আশ্চর্যজনক ছিল।

পরিশেষে শরীয়তমাদার এসব অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন: মূল বিষয় হল, মুসলিম বিশ্বে এমনও অনেক অজানা বিষয় ও ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলির প্রতি মনোযোগ একজন ধর্মের প্রতি নিবেদিত ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূণ্য ও উপকারী সাব্যস্ত হতে পারে হতে পারে।#176