‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ABNA
শনিবার

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

৩:৫২:১৩ PM
1393915

৫০ বছর আগে আরবাঈনের আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন ও ইজতিমা সংক্রান্ত ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতার ভাষণ

শিয়া মুসলমানরা ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী; তারা ছিল এমন এক সমাজ যারা এক জয়গায় একই স্থানে বাস করত না। তারা পবিত্র মদীনায়, কূফায়, বসরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তারা আহওয়াযে ছিল; তারা পবিত্র কোমে ছিল; তারা ছিল খোরাসানে ; তারা দেশের (ইসলামী ভূখণ্ডের) বিভিন্ন স্থানে (ও অঞ্চলে) ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তবে (তারা ছিল) ভিন্ন ভিন্ন দেহে এবং (একই দেহের) বিভিন্ন অংগ-প্রত্যঙ্গে প্রবহমান এক আত্মা।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): অর্ধ শতাব্দী আগে অর্থাৎ যখন আরবাঈনের অনুষ্ঠান আজকের মত ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদার রূপ পরিগ্রহ করে নি এবং ব্যাপকতা লাভ করে নি তখন হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেঈ ১৩৫২ ফার্সী সালে শুক্রবার (মোতাবেক ২০ সফর ১৩৯৪ হিজরী) পবিত্র মাশহাদ নগরীস্থ ইমাম হাসান মুজতাবা (আ) মসজিদে নাহজুল বালাগাহর খুতবা সমূহের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত ধারাবাহিক পাঠ দানের অনুষ্ঠানের রাত ইমাম হুসাইনের (আ) শাহাদাতের আরবাঈন দিবসের রাত অর্থাৎ ২০ সফরের রাতের সাথে এক হয়ে যাওয়া উপলক্ষে আরবাঈনের যিয়ারতের গুরুত্বের কারণ সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ প্রদান করেছিলেন। তার বক্তব্যের বিস্তারিত বিবরণ নিচে প্রদান করা হচ্ছে :

আপনারা সবাই জানেন কি যে ঈমানের এক অন্যতম চিহ্ন ও নিদর্শন হচ্ছে আরবাঈনের যিয়ারত? আমার জানা নেই যে এ রেওয়ায়ত কত টুকু সহীহ (বিশুদ্ধ)। আর আমি জোর দিয়েও বলছি না যে রেওয়ায়তের অর্থ ঠিক এটাই যা আমি ধারণা করেছি। তবে এর আসল বাস্তবতা ঠিক এটাই যে অন্যান্য সম্ভাব্য অর্থ এ ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে সেগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একটি এর অর্থ হতে পারে বলে আমি সম্ভাবনা দিচ্ছি। তবে

আমি যে সম্ভাবনার কথা বলছি তা যদি বিদ্যমান থেকে থাকে তাহলে এর অর্থাৎ যিয়ারত-ই আরবাঈনের বহু প্রত্যয়নকারী ও সহায়ক বিষয় বিদ্যমান আছে ।

শিয়া মুসলমানরা ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী; তারা ছিল এমন এক সমাজ যারা এক জয়গায় একই স্থানে বাস করত না। তারা পবিত্র মদীনায়, কূফায়, বসরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তারা আহওয়াযে ছিল; তারা পবিত্র কোমে ছিল; তারা ছিল খোরাসানে ; তারা দেশের (ইসলামী ভূখণ্ডের) বিভিন্ন স্থানে (ও অঞ্চলে) ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তবে (তারা ছিল) ভিন্ন ভিন্ন দেহে এবং (একই দেহের) বিভিন্ন অংগ-প্রত্যঙ্গে প্রবহমান এক আত্মা।

তসবীহের দানাগুলোকে যেমন একটা সূতা বা তন্তু (আঁশ) পরস্পর যুক্ত করে ঠিক (তেমন ছিল শিয়ারা)। এই সূতা কী ছিল ? তা ছিল তাশাইয়ু অর্থাৎ শিয়া মাযহাবের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বর প্রতি অনুগত্য করার রজ্জু বা সূত্র; তা ছিল শিয়াদের সর্বোচ্চ নেতা অর্থাৎ ইমামের প্রতি আনুগত্য। শিয়াদের আনুগত্যের সকল সূত্র ও রজ্জু ছিল ঐ স্থানের (শিয়া মাযহাবের কেন্দ্রীয় নেতা অর্থাৎ ইমাম) সাথে সংযুক্ত। আর এই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল হৃৎপিণ্ড স্বরূপ যা সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নির্দেশ দানকারী। দুজন শিয়ার পক্ষে তাদের পারস্পারিক অবস্থা জানা সম্ভব ছিল না । তবে এমন কতিপয় ব্যক্তি ছিলেন যারা সবার অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত ও অবহিত থাকতেন । তাদের আনুগত্য ছিল হিসাব নিকাশ করা এবং তাদের শ্লোগান ও ফরিয়াদও ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আদেশের ভিত্তিতে প্রদত্ত । তাদের নীরবতাও ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিকল্পনা মাফিক।

তাদের সব কিছুই ছিল হিসাব করা । কিন্তু তাদের কাজের একটা মাত্র খুঁত ছিল এবং তা ছিল এটা যে তাদের মধ্যে পারস্পরিক দেখা সাক্ষাৎ খুব কমই হত । একই নগর বা শহরের বাসিন্দারা একই অঞ্চলের শিয়াদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হত । কিন্তু একটা আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমার প্রয়োজন ছিল (মহানবীর -সা- পবিত্র আহলুল বাইতের -আ- মাসূম ) ইমামদের যুগের শিয়াদের জন্য ।

এ বিশ্ব ইজতেমা বা মহাসম্মেলন নির্ধারিত হয়েছিল এবং এর অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়কালও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ঘোষণা দেওয়া হয় যে ঐ মহাসমাবেশ ও মহাসম্মেলনে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে। আর এ সময়কালটা হচ্ছে আরবাঈনের দিবস (২০ সফর) । আর অংশগ্রহণের স্থান (মহাসম্মেলন স্থল) হচ্ছে পবিত্র কারবালা । কারণ শিয়াদের প্রাণ ও রূহ্ হচ্ছে পবিত্র কারবালা। আশুরাই হচ্ছে শিয়া মন ও আত্মা । শিয়া মুসলমানদের দেহে আশুরার স্পন্দন স্পষ্ট অনুভূত ও দৃষ্ট হয়। শিয়ারা যেখানেই থাকুক না কেন সেখানেই তারা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ইমাম হুসাইনের (আ) আশুরার অনুগামী ও অনুবর্তী ।

এই স্পন্দন সমূহ যা শিয়াদের মধ্যে অনুভূত ও দৃষ্ট হয় তা আপনারা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করছেন ও দেখছেন । আসলে এ স্পন্দনসমূহ ঐ পবিত্র মাযার থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে। এ সব অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আসলে ঐ পবিত্র আত্মা থেকে এবং উচ্চ মর্যাদাবান সমাধির মাটি থেকে উত্থিত হয়ে অন্তর ও প্রাণ সমূহে উপনীত হয়েছে এবং তা মানুষকে উত্তপ্ত গোলায় পরিণত করে শত্রুর অন্তরের গভীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে (যার ফলে শত্রুর হৃদয়কে বিস্ফোরিত হয়ে গেছে) ।

অতএব, আরবাঈন আসলেই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও প্রসঙ্গ । আরবাঈন অর্থাৎ এক আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন ও মহাসমাবেশে শিয়াদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা ও প্রতিশ্রুতি (মীআদ) ঐ ভূখণ্ডের (পবিত্র কারবালা) জন্য যা স্বয়ং নিজেই পূণ্যস্মৃতি বিজড়িত। ঐ ভূখণ্ড স্মৃতিসমূহের ভূখণ্ড যেখানে রয়েছে অতি মর্যাদা সম্পন্ন ও উচ্চাঙ্গের স্মৃতি সমূহ, অত্যন্ত প্রিয় স্মৃতি সমূহ, শহীদদের পূণ্যভূমি, আল্লাহর পথে নিহতদের মাযার। এখানেই যেন একত্রিত হয়ে যায় তাশাইয়ু (শিয়া মাযহাব) এবং শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা। এখানেই যত সম্ভব তত বেশি তারা ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বস্ততার প্রতিশ্রুতির হস্ত একে অপরের দিকে প্রসারিত করে দেয়।

আজও যদি শিয়া মুসলমানরা সক্ষম হয় তাহলে তারা যেন ঐ পবিত্র পূণ্যভূমিকে (পবিত্র কারবালা-ই মু'আল্লা) এ ধরণের মী'আদ অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও বাস্তবায়নের স্থলে পরিণত করতে পারে। অবশ্যই তা হবে খুবই যথাযথ (সময়োচিত) ও আকর্ষণীয় কাজ এবং তা হবে এমন এক পথের অনুসরণ ও পরিক্রমণ যা

আমাদেরকে সুপথ প্রদর্শক ইমামগণ (আ) দেখিয়েছেন ও প্রদর্শন করেছেন।

ইমাম হাসান মুজতাবা ( আ ) মসজিদে মহান রাহবারের বক্তৃতা , ২৪ এসফান্দ ১৩৫২ ফার্সী সাল

অনুবাদ : মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান