১৩ অক্টোবর ২০২৪ - ১৯:৩২
তাজিকিস্তানের শিয়াদের বর্তমান অবস্থা ; সরকারি বিধিনিষেধ ওয়াহাবিদের অপতৎপরতা

তাজিকিস্তানে আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা ও হুমকি হলো ওয়াহাবিরা। ওয়াহাবিরা বিভিন্ন অজুহাতে শিয়াদের উপর মিথ্যারোপ করে এবং দেশটির সাধারণ জনগণ ও সরকারের মন শিয়াদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা চালায়।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): তাজিকিস্তান; সেন্ট্রাল এশিয়ারা ৫ প্রজাতন্ত্রের অন্যতম একটি দেশ, এর রাজধানীর নাম দুশানবে; দেশটির বেশীরভাগ মানুষই সুন্নি-হানাফি মাযহাবের অনুসারী এবং শীয়াদের মধ্যে ইমামিয়া ও ইসমাঈলিয়া শিয়ারা মূলতঃ এদেশে বসবাস করে আসছে বহুবছর ধরে।

তাজিকিস্তানের ইসমাইলী শিয়ারা রাজধানী দুশানবে ছাড়াও তাদের একটা বড় অংশ বাদাখশান অঞ্চলে বিশেষভাবে শিগানান, ওয়াখান, লাঘমান এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বসবাস করে। পামীর উচ্চভূমি, চীন সীমান্ত এবং আশকাশাম এলাকাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসমাঈলী বসবাস করে। ইসমাইলীরা জাতিগতভাবে সাধারণত ‘তাজিক’। তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তানের ইসমাঈলীরা ‘নাযযারি ইসমাইলী’।

তাজিকিস্তানের বাসিন্দা ও আহলে বাইতের অনুসারী জনাব ‘ইউসুফ হায়দারোভ’র সাথে দেশটিতে এসনা আশারি ও ইসমাঈলী শিয়াদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বার্তা সংস্থা আবনা প্রতিবেদক মতবিনিময় করেছেন। তারই চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো:

 

আবনা: শুরুতে তাজিকিস্তানে বসবাসরত শিয়াদের অবস্থা সম্পর্কে বলুন।

-তাজিকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ১ কোটি; এর মধ্য থেকে শতকরা ২ ভাগ ইসমাঈলী শিয়া বাদাখশান অঞ্চলে বসবাস করে।

তাজিকিস্তানের ইসনা আশারি শিয়াদের অফিশিয়াল কোন পরিসংখ্যান উল্লিখিত না হলেও মাঠপর্যায়ের গবেষণার ভিত্তিতে দেশটিতে প্রায় ১০ হাজার নাগরিক শিয়া এসনা আশারি; যাদের বেশীরভাগ সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় বুখারা ও সামারকান্দ থেকে তাজিকিস্তানে হিজরত করেছে। একইভাবে ১৯৯৬ সালে পরিবেশ উন্মুক্ত হওয়ার পর মহানবি (স.)-এর আহলে বাইতের অনুরাগী বহুসংখ্যক যুবক ইসলামি শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে আসেন এবং বর্তমানে তারা ইরানের বিভিন্ন শহরে জ্ঞানচর্চা করছেন।

আবনা: তাজিকিস্তানে তাবলিগী কার্যক্রমে প্রধান বাধা সম্পর্কে বলুন।

বলাবাহুল্য যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায়ের সামনে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করে; এ কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া দেশটির নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও দেশটিতে এখনও কোন হুসাইনিয়া (ইমামবাড়ি) নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি। অবশ্য ইসমাইলী শিয়াদের জন্য রাজধানী দুশানবে’তে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং তারা তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সেখানেই আয়োজন করে থাকে।

তাজিকিস্তানে শিয়াদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হল ওয়াহাবিরা; তারা তাদের স্বার্থ উদ্ধারে শিয়াদের মাঝে অনুপ্রবেশ করে এবং তাদের ঠিকানা খুঁজে বের করে। অতঃপর বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বিরুদ্ধে উদ্ভট অপবাদ আরোপ করে শিয়াদের সম্পর্কে সরকার ও জনসাধারণের মন বিষিয়ে তোলে।

আবনা: ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা সম্পর্কে বলুন।

তাজিকিস্তানে ‘ইমাম আবু হানিফা’ নামে মাত্র একটি মাদ্রাসা রয়েছে, যা সরকারের তত্ত্বাবধানে এবং তাদের নির্ধারিত নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এই মাদ্রাসা যুবকদের প্রশ্নের উত্তর প্রদানে ব্যর্থ বিশেষ করে যে সকল যুবক ইসলামি শিক্ষা অর্জনে উৎসুক। এছাড়া, অন্যান্য মাযহাবের অনুসারীদের কোন স্থানে এই মাদ্রাসাতে নেই।

আবনা: ইসলামি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রচারে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন?

কুরআন শিক্ষার ক্লাস, শোকানুষ্ঠান ইত্যাদির মত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রকাশ্যে আয়োজন করা সম্ভব নয়। অবশ্য বিগত কয়েক বছর ধরে আল্লাহর রাসূল (স.) ও তাঁর আহলে বাইত (আ.)-এর ভক্তরা বিভিন্ন শহরে নিজেদের বাসাবাড়িতে আযাদারি ও শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

আবনা: আহলে বাইতের মাযহাব সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরস্পরকে অবগত করার জন্য কোন মাধ্যম ব্যবহার করেন?

কর্মসূচী ও সমাবেশের খবর প্রচারের জন্য বিশেষ কোন মাধ্যম ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত একজনের মাধ্যমে আরেকজনের নিকট সংবাদ পৌঁছে যায় এবং এ সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা বিভিন্ন বাহানায় নির্ধারিত গৃহে উপস্থিত হয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করে থাকে।

আবনা: তাজিকিস্তানে ওয়াহাবিদের তৎপরতা সম্পর্কে বলুন, ওয়াহাবিরা জনগণকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতে কি ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে?

যেহেতু সেন্ট্রাল এশিয়ার বেশীরভাগ জনগণ আহলে সুন্নত, তাই মোটামুটিভাবে তারা সৌদি চিন্তাধারা কেন্দ্রিক তৎপরতায় লিপ্ত। ২০১০ সালে সৌদি দূতাবাস উদ্বোধনের পর থেকে তাজিকিস্তানে ওয়াহাবিদের তৎপরতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াহাবি চিন্তাধারার বই প্রকাশ, ওয়াহাবি চিন্তাধারায় প্রভাবিত বিভিন্ন মুভমেন্টকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, মসজিদ ও ওয়াহাবি মতবাদের প্রচারকার্যে নিয়োজিত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ ওয়াহাবি মুবাল্লিগ প্রেরণের মাধ্যমে তারা ওয়াহাবি চিন্তাধারাকে তাজিকিস্তানে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছে।

আবনা: তাজিকি যুবকদের মাঝে কত শতাংশ তাকফিরি ও উগ্র চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত?

নিশ্চিতভাবে সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব না হলেও তাজিকিস্তানের বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় উপস্থিত হয়ে যা কিছু অনুমান করা যায় তার ভিত্তিতে শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ সালাফি চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত। ১৯৯৯ সাল থেকে তাজিকিস্তানে সালাফি ও ওয়াহাবি চিন্তাধারা বিদ্যমান। এদেরকে তাদের পোশাক-আশাক, দাড়ি বা তাদের নামায পড়ার পদ্ধতি দেখেই চিহ্নিত করা যেত। আর এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, সালাফিবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

আবনা: তাজিকিস্তানে আহলে বাইতের অনুসারীদের সম্প্রসারণের পথে ওয়াহাবিবাদ একটি বড় বাধা, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কি সমাধান রয়েছে?

ইসলাম ধর্ম প্রচারে আমাদের পদ্ধতি হলো আহলে বাইত (আ.)-এর সীরাত; যেভাবে ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন: ‘মহান আল্লাহ ঐ বান্দার উপর রহমত করুন যে আমাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয় এবং জনগণকে তা শিক্ষা দেয়, যদি জনগণ আমাদের কথা ও ভাষ্যের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানত তাহলে তারা আমাদের অনুসরণ করত’। সুতরাং তাজিকিস্তানে তাবলিগ ও শিয়া মাযহাবের সম্প্রসারণের জন্য আহলে বাইত (আ.)-এর প্রজ্ঞা, ভাষ্য ও উত্তম আচরণকে মানুষের সামনে তুলে ধরাই যথেষ্ট।

তাজিকিস্তানের সাধারণ ছাত্র, ধর্মীয় ছাত্র এবং যারা রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আহলে বাইতকে ভালবাসে তাদের চিন্তার লেভেল বেশ উন্নত। এ কারণে যদি উক্ত পদ্ধতি (ইমাম রেযা (আ.) বর্ণিত) অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে সৌদি অর্থায়নে তৎপর বহুসংখ্যক সালাফি ও ওয়াহাবি মুভমেন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। একইভাবে তা জনসাধারণকে আহলে বাইত (আ.)-এর দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কারণ হবে। এছাড়া তারা মধ্যপন্থা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টিকে রপ্ত করবে।

আবনা: ওয়াহাবিরা ছাড়া আপনাদের তৎপরতার সামনে কি আর কোন বাধা রয়েছে?

হ্যাঁ, ইসলাম ধর্ম প্রচার-প্রসারে অন্যান্য বাধাও রয়েছে; তাবলিগের ক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী তাজিকিস্তানে নির্ধারিত নীতিমালা রয়েছে। যে কেউ সহজে মসজিদের ইমাম হতে পারে না বা কুরআন শিক্ষা দিতে পারে না। এ সকল কাজের জন্য অনুমোদন প্রয়োজন এবং এই অনুমোদন সাধারণত সবাইকে প্রদান করা হয় না। শুধুমাত্র সরকারের পক্ষ থেকে সত্যায়িত হওয়া ব্যক্তিদেরকেই প্রদান করা হয়। তাজিকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশী হানাফি মাযহাবের অনুসারী হলেও মসজিদ, মাদ্রাসা এমনকি ঘরোয়াভাবেও অনুমোদন ছাড়া কুরআন শিক্ষা দেওয়া নিষেধ, এমনকি নিজের সন্তানকেও। অতএব, ওয়াহাবি ও সালাফিবাদ ছাড়াও তাজিকিস্তানে ইসলাম ধর্ম প্রচার-প্রসারের পথে সরকারি এই নিষেধাজ্ঞাও একটা বড় বাধা। কিন্তু এ সকল বাধা উপেক্ষা করে তাজিকিস্তানে আহলে বাইতের অনুসারীগণ নিজেদের দায়িত্ব পালনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মহানবি (স.) কর্তৃক আনীত ও প্রচারিত প্রকৃত ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করছে।

আবনা: যদি বিশেষ কোন বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করতে চান, তা বলুন।

আমরা ইরান ও তাজিকিস্তানের মাঝে সুসম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তৎপরতা বিষয়ক পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আশাবাদী। নিশ্চিতভাবে (দু’পক্ষের অংশগ্রহণে) বিভিন্ন সেমিনার ও মতবিনিময় সভার আয়োজন মুসলিম উম্মাহ’র ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদীদের অনুপ্রবেশ রুখবে এবং মুহাম্মাদি (স.) ইসলামের শত্রুদের সকল প্রকার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করবে।#176