ইবরাহিম (আ.) এই দ্বিন ইসলামের অনুসারীদের মুসলিম নাম দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন।
তিনি দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। এ তো তোমাদের পিতা ইবরাহিমের মিল্লাত। তিনি এর আগে তোমাদের নাম দিয়েছেন মুসলিম।’
(সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)
ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার ফলে রাসুল (সা.)-এর আগমন হয়েছে।
ইবরাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের রব! তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন রাসুল প্রেরণ করো যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করবে; তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১২৯)
সেই রাসুল হলেন মুহাম্মদ (সা.)।
হজের জন্য ইবরাহিম (আ.)-এর
আহ্বান : ইবরাহিম (আ.) ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন এবং ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করেন।
পরে আল্লাহর হুকুমে স্ত্রী ও শিশুসন্তান ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন। ইবরাহিম (আ.) ছেলে ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করে মানুষকে বায়তুল্লাহর হজ করার জন্য আহ্বান করেন। আল্লাহ বলেন, ‘এবং স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম, আমার সঙ্গে কোনো শরিক স্থির করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য, যারা তাওয়াফ করে এবং যারা নামাজে দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে। এবং মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে ও ক্ষীণকায় উঠের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে, যাতে তারা তাদের কল্যাণকর স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৬-২৮)
মাকামে ইবরাহিম : যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ইবরাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন সেটি হলো মাকামে ইবরাহিম।
কাবাঘর নির্মাণকালীন পদচিহ্নবিশিষ্ট সেই পাথর আজও সেখানে বিদ্যমান রয়েছে। তাওয়াফের পরে সেখানেই দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘এবং সে সময়কে স্মরণ করো, যখন কাবাগৃহকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ করো।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১২৫)
সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো : ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী হাজেরাকে পুত্র ইসমাঈলসহ মক্কায় রেখে যাওয়ার পর মা হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে জনশূন্য এই প্রান্তরে অবস্থান করতে থাকেন। একসময় কঠিন পিপাসা তাঁকে পানির খোঁজে বের হতে বাধ্য করে। তিনি শিশুকে রেখে সাফা-মারওয়া পাহাড়ে বারবার দৌড়ান। সাতবার ছোটাছুটি করেও পানির সন্ধান না পেয়ে শিশুর কাছে ফিরে আসেন। হাজেরা (আ.)-এর সেই সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ানোই হাজিদের সাঈ বাইনাস সাফা ওয়া মারওয়া; যে পাহাড়দ্বয়কে মহান আল্লাহ নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে কেউ কাবাগৃহের হজ বা ওমরাহ সম্পন্ন করে এই দুটির মধ্যে সাঈ করলে তার কোনো পাপ নেই।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৫৮)
হাজিদের পানীয় : হাজেরা (আ.) সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার ছোটাছুটি করে পানির সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসার পর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়। জিবরাইল (আ.) এসে শুষ্ক মরুভূমিতে পানির একটি ঝর্ণাধারা বইয়ে দেন। এই ধারাই জমজম কূপ। পানির সন্ধান পেয়ে জীবজন্তু আসতে থাকে। জীবজন্তু দেখে মানুষ এসে বসতি গড়তে থাকে। এভাবে একদিন গড়ে ওঠে মক্কা নগরী। হাজিদের পানীয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় সেই জমজমের পানি।
শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ : ইবরাহিম (আ.) যখন আল্লাহর নির্দেশমতো স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করতে এগিয়ে চললেন; পথিমধ্যে শয়তান তিনবার ইবরাহিম (আ.)-কে প্রতারিত করার চেষ্টা করে। ইবরাহিম (আ.) প্রতিবারই শয়তানকে সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। প্রশংসনীয় এই কাজের স্মৃতি স্মরণ করে হাজিরা মিনায় তিনবার তিন স্থানে সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘কঙ্কর নিক্ষেপ ও সাফা-মারওয়ার মধ্যে দৌড়ানোকে আল্লাহর স্মরণের মাধ্যম সাব্যস্ত করা হয়েছে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৯০২)
কোরবানি ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতিময়
আমল : ১০ জিলহজ এক বরকতময় ও ঐতিহাসিক দিন। সেদিন ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নিজের কিশোর সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হন এবং তার গলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহর প্রতি তাঁর আনুগত্য, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার স্বাক্ষর স্থাপন করেন। মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাঈল (আ.)-কে নিরাপদ রেখে তাঁর স্থলে পশু কোরবানির ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ বলেন, (ইবরাহিম বললেন) ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করো।’
অতঃপর আমি তাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহিম বলল, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে আমি তোমাকে জবাই করছি, এখন তোমার অভিমত কী বলো?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম তাকে কাত করে শায়িত করল, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে।’
(সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০০-১০৭)
মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর এই কর্মকে আল্লাহপ্রেমের প্রতীক হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরণীয় আদর্শ সাব্যস্ত করেছেন। মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর ঐতিহাসিক কোরবানির ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন, ‘আর আমি একে পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইবরাহিমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক।’
(সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০৮-১০৯)
পরিশেষে বলা যায়, ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার যে প্রতিচ্ছবি মক্কার জনপদে ছড়িয়ে আছে সেই আধ্যাত্মিকতার পূর্ণরূপ হলো মুসলিম উম্মাহর হজ। মুসলিম উম্মাহর জন্য নির্ধারিত কোরবানি, যা জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পশু জবাই করার মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়, তা-ও মূলত ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে সূচিত হয়েছে।
342/
Your Comment