এনবিসি নিউজ একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে ট্রাম্প প্রশাসন গাজায় বসবাসকারী দশ লাখ ফিলিস্তিনিকে স্থায়ীভাবে লিবিয়ায় স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছে। এই পরিকল্পনার অধীনে, ফিলিস্তিনিদের গ্রহণের বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার কোটি কোটি ডলারের জব্দকৃত সম্পদ ছেড়ে দেবে।
পার্সটুডের মতে, ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক প্রস্তাবিত দশ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরের পরিকল্পনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল পূর্বে ফিলিস্তিনিদের অন্য ভূমিতে স্থানান্তরের শিরোনামে যে নীতিমালা রূপরেখা দিয়েছিল তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই পরিকল্পনাটি প্রতিবেশী দেশ এবং অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল। তবে, গাজার জনগণকে লিবিয়ায় স্থানান্তরিত করার নতুন পরিকল্পনার ঘোষণা থেকে বোঝা যায় যে ট্রাম্প প্রশাসন এখনও সমাধান খুঁজছে এবং গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিভিন্ন বিকল্প বেছে নিচ্ছে, এবং ফিলিস্তিনি এবং বিশ্বের অনেক দেশের সমস্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও গাজা যুদ্ধের অবসান এবং ইসরাইলের আকাঙ্ক্ষার অন্যতম সমাধান হিসেবে এই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপর জোর দিচ্ছে।
জাতিসংঘের মুখপাত্র সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন যে আমরা এমন যেকোনো পরিকল্পনার বিরোধিতা করি যা গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে অথবা যেকোনো জাতিগত নির্মূলের দিকে পরিচালিত করে। ইতিমধ্যে, হামাস আন্দোলনও বারবার ফিলিস্তিনি জনগণের তাদের ভূমিতে থাকার অধিকারের উপর জোর দিয়েছে এবং যেকোনো স্থানান্তর বা নির্বাসনের বিরোধিতা ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি হামাস আন্দোলনের অন্যতম নেতা সামি আবু জুহরি উল্লেখ করেছেন যে গাজা উপত্যকার পুনর্গঠনের মতো অজুহাতে গাজার জনগণের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, এই প্রকল্পগুলো মূল্যহীন এবং নিষ্ফল এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলি সরকার বল প্রয়োগের মাধ্যমে যা অর্জন করতে পারেনি তা রাজনৈতিক খেলার মাধ্যমে অর্জন করতে পারবে না।
ট্রাম্পসহ ইসরাইল এবং তার সমর্থকদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হল রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের বিষয়টি বাদ দেওয়া। গত বছর গাজা যুদ্ধ এবং ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির কারণে এই বিষয়টি বিভিন্নভাবে আরও গুরুত্বের সাথে উত্থাপিত হয়েছে। তবে,এখন গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের লিবিয়ায় স্থানান্তরের বিষয়টি একটি নতুন এবং বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হল লিবিয়াকে বেছে নেয়া যে দেশটিতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো নেই।
২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির উৎখাতের পর লিবিয়া বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার চক্রে প্রবেশ করেছে এবং দেশটিতে কোনো কেন্দ্রীয় ও নির্ভরযোগ্য সরকার গঠিত হয়নি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিভক্ত এবং এক দশকেরও বেশি সময় পরেও দেশটি শান্তির মুখ দেখেনি। এই ধরনের পরিবেশে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বসতি স্থাপন খুব বেশি প্রতিরোধ ছাড়াই এবং ওয়াশিংটন এবং তার মিত্রদের জন্য বড় আন্তর্জাতিক বাধা ছাড়াই সম্পন্ন করা যেতে পারে। অন্যদিকে আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মার্কিন সরকার দেশের জমে থাকা অর্থ মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার কাঠামোর মধ্যে এই অর্থ জব্দ এবং অবরুদ্ধ করা হয়েছিল এবং লিবিয়ানদের এই সম্পদের মুক্তি এবং অ্যাক্সেস এই দেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে, এই আর্থিক হাতিয়ার ব্যবহার করে আমেরিকা এমন একটি চুক্তি করার চেষ্টা করছে যেখানে ফিলিস্তিনিদের "আতিথ্য" দেওয়ার বিনিময়ে লিবিয়ান সরকার বা এর প্রভাবশালী বাহিনী তার অর্থ পাবে। এটি এমন এক ধরণের রাজনৈতিক বিনিময় যা লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের লিবিয়ার মতো দূরবর্তী দেশে স্থানান্তর আসলে গাজা উপত্যকার উপর ইসরাইলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সহজতর করার দিকে একটি পদক্ষেপ। যদি গাজার জনসংখ্যা হ্রাস পায় তাহলে আরো ইসরাইলিদের বসতি বা নিরাপত্তা পরিকল্পনার জন্য আরো ভূমি প্রস্তুত হবে। এছাড়াও, গাজার জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ, যা প্রতিরোধের জন্য একটি সম্ভাব্য মানবসম্পদ, স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে এই হুমকি কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরাইল এই অঞ্চলের উপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
প্রকৃতপক্ষে, ফিলিস্তিনিদের লিবিয়ায় স্থানান্তরের মাধ্যমে একটি নতুন পরিকল্পনার ঘোষণা আবারও দেখিয়েছে যে ট্রাম্প প্রশাসন এবং তার মিত্ররা এখনো "প্রত্যাবর্তনের অধিকার" নীতিকে বাতিল করতে চাইছে। একটি নীতি যা ফিলিস্তিনি সংগ্রামের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি এবং ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাবের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
যদিও গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের লিবিয়ায় স্থানান্তরের পরিকল্পনা পর্যালোচনা এবং আলোচনার অধীনে রয়েছে তবে এর রূপরেখা প্রকাশ ট্রাম্প প্রশাসনের একটি স্পষ্ট নির্দেশনার ইঙ্গিত দেয়। "এই ধরণের পরিকল্পনা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করে হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাসেম নাইম বলেন: ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমির প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল এবং এর প্রতি দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা তাদের ভূমি, তাদের পরিবার এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করতে এবং যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। গাজার জনগণসহ ফিলিস্তিনিদের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র ফিলিস্তিনিদেরই।"
Your Comment