৫ জুন ২০২৫ - ২১:৩৮
Source: Parstoday
ইসরাইলি দখলদারিত্বের আগে ফিলিস্তিন কি 'খালি ভূখণ্ড' ছিল?

ইতিহাসের বর্ণনাগুলো সবসময় জনমত গঠন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে থাকে। এই বর্ণনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হল ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে ইসরাইল এবং তার সমর্থকরা ফিলিস্তিনের ভূমির কল্পচিত্র উপস্থাপন করে। এই বিকৃত চিত্রে বা বর্ণনায় ফিলিস্তিনকে একটি খালি, জনবসতিহীন এবং অব্যবহৃত ভূমি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে; ইহুদিবাদীদের আগমনের আগে যার কোনও ইতিহাস, সংস্কৃতি বা মানুষ ছিল না। কিন্তু আসলেই কি তাই?

"খালি ভূমি"- কথাটি ফিলিস্তিনের ওপর দখলদারিত্বকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইহুদিবাদীদের প্রচারণার অন্যতম হাতিয়ার। ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৮০০ সালের দিকে ফিলিস্তিন একটি খালি এবং নির্জন মরুভূমি ছিল বলে যে দাবি করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। গবেষণায় দেখা যায় যে ফিলিস্তিন সেই সময়ে একটি গতিশীল, আবাদি এবং সমৃদ্ধ ভূমধ্যসাগরীয় সমাজ ছিল। কৃষিজমি, বাণিজ্যিক বন্দরের নেটওয়ার্ক, অভ্যন্তরীণ বিস্তৃত স্থলপথ এবং বায়তুল মোকাদ্দাস ও বেথেলহামের মতো ঐতিহাসিক শহরগুলো এই অঞ্চলের উন্নয়ন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার প্রমাণ।

প্রকৃতপক্ষে, ফিলিস্তিন "খালি ভূমি"- ছিল বলে যে দাবি করা হয়েছে তার সাথে এ অঞ্চলের  সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক এবং জনসংখ্যাতাত্ত্বিক অবস্থানের সাথে কোনো মিল নেই। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে ফিলিস্তিনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে এই ভূখণ্ড কখনই জনশূন্য মরুভূমি ছিল না বরং এটি স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পরিচয়সহ একটি জীবন্ত, জনবহুল সমাজ ছিল; কিন্তু এ বাস্তবতা ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে চলেছে। ইসরাইল এবং তার সমর্থকদের প্রচারিত বর্ণনা হচ্ছে যে ইহুদিবাদীদের আগমনের আগে ফিলিস্তিন একটি খালি, জনশূন্য এবং জনবসতিহীন ভূমি ছিল। এই পৌরাণিক কল্পকাহিনী, আজও ইসরাইলি পাঠ্যপুস্তক এবং সরকারী মিডিয়াতে শেখানো  হচ্ছে এবং এ মিথ্যা বর্ণনাকে এই ভূমি দখল এবং ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা প্রমাণের আদর্শিক ভিত্তি হিসাবে সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নথিপত্র তাদের এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে।

'ফিলিস্তিন' নামটি প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সময় পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যের সময় এই নামটি এই অঞ্চলের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই সময়কালে ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা বৃহত্তর রোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের আগমণের সাথে সাথে, ফিলিস্তিন মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডে পরিণত হয়, যেখানে প্রথম কিবলা এবং ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান, আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত। এরপর, ফিলিস্তিন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরব ও মুসলিম বিশ্বের অংশ ছিল। এমনকি ক্রুসেডের মতো সময়কালেও যখন এর নিয়ন্ত্রণ কিছু সময়ের জন্য খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়, তখনও এই ভূমি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ষোড়শ শতাব্দী থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত, ফিলিস্তিন ওসমানিয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ছিল, যা সেসময় ফিলিস্তিনি সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ওসমানিয়রা যখন সেখানে এসে পৌঁছায়, তখন তারা মূলত গ্রামীণ, মুসলিম এবং আরবিভাষী সমাজের মুখোমুখি হয়। সেই সময়ে জনসংখ্যার মাত্র ৫% ইহুদি ছিল এবং খ্রিস্টানদের একটি ছোট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও ছিল। ইসরাইলি প্রচারণার বিপরীতে, বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, সেই সময়ে ইহুদিরা শুধু যে কেবল সংখ্যালঘু ছিল তাই নয় একইসাথে তাদের অনেকেই ইহুদিবাদীদের অভিবাসনেরও বিরোধিতা করেছিল।

সাংস্কৃতিকভাবে, ফিলিস্তিনি জনগণের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় ছিল: তাদের নিজস্ব আরবি উপভাষা ছিল, তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি ছিল এবং বিশ্ব মানচিত্র এবং সরকারী নথিতে তাদের "ফিলিস্তিন" নামক একটি ভূমির বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ‌ইসরাইলিদের আগমনের আগে থেকেই ফিলিস্তিনি অভিজাতদের মধ্যে আত্মীয়তা, জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতার অনুভূতি জোরদার হচ্ছিল। আরব জাতীয়তাবাদ যা একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশে বিকশিত হচ্ছিল, ফিলিস্তিনেও তার প্রভাব ফেলেছিল। এর পাশাপাশি আমেরিকা  থকে আসার খ্রিস্টধর্ম প্রচারকারী মিশনারিরাও প্রভাব বিস্তার করেছিল। এক পর্যায়ে মুসলিম এবং খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো দ্রুত ফিলিস্তিনে সংগঠিত হয় এবং ওসমানিয়দের কাছ থেকে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়। এমনকি কিছু স্থানীয় ইহুদিও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। অটোমান বা ওসমানিয় সাম্রাজ্যের পতনের প্রাক্কালে, ফিলিস্তিন নিজেকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার পথে ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে 'ফিলিস্তিন'-এর মতো সংবাদপত্রগুলো এই নতুন পরিচয়কে তুলে ধরেছিল।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ আধিপত্যের সূচনা এবং ইউরোপ ও অন্যান্য স্থান থেকে ইহুদিদের নান প্রলোভন দেখিয়ে অভিবাসনের ফলে ফিলিস্তিন নামক এই ভূখণ্ডের ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংস হতে শুরু করে। ব্রিটেন তার রাজনৈতিক সমঝোতায় কখনও নির্দিষ্ট করেনি যে ফিলিস্তিনের মালিক কে: আদিবাসী আরব বাসিন্দারা নাকি ইহুদি অভিবাসীরা? এই অস্পষ্টতা ইহুদিবাদীদের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূমি ধীরে ধীরে দখলের পথ প্রশস্ত করে। সীমান্তের নতুন কাঠামো ইহুদিবাদীদের "ইসরাইল ভূমি" কে ইহুদিদের জন্য একটি বৈধ আবাসভূমি হিসেবে চিত্রিত করতেও সাহায্য করেছিল।

"ফিলিস্তিন ছিল একটি শূন্য ভূমি" এই মিথটি ইসরাইলকে বৈধতা দেওয়ার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলেও, ঐতিহাসিক নথিপত্র, সাংস্কৃতিক প্রমাণ এবং জনসংখ্যার বাস্তবতার আলোকে প্রমাণিত হয় যে ফিলিস্তিন কখনই জনশূন্য বা খালি ময়দান ছিল না।

"টেন ফেমাস মিসকনসেপশনস অ্যাবাউট ইসরাইল" বইয়ের লেখক ইলান পেপ তথ্যপ্রমাণ সহকারে এবং নিরপেক্ষ গবেষণায় দেখান যে ইহুদিবাদ একটি মিথ্যা আখ্যান তৈরি কোরে ফিলিস্তিন এবং এর জনগণের পরিচয় ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে।

প্রকৃতপক্ষে, ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে ফিলিস্তিন কোনো শূন্য ভূখণ্ড তো ছিলই না বরং ঐতিহাসিক পরিচয়সহ একটি জীবন্ত ও আবাদি ভূমি ছিল এটি।#

Your Comment

You are replying to: .
captcha