‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ABNA
বৃহস্পতিবার

১৮ মে ২০২৩

৬:২৬:১০ AM
1366644

বাংলাদেশে শিয়াদের মাযহাবী আচারানুষ্ঠান পালনে কোন বাধা নেই / ইসলামী বিপ্লবের সুবাদে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন মসজিদ মুখী : সৈয়দ ইবরাহীম খলিল রাজাভি

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি বলেন: প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রায় তিন হাজার আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীর উপস্থিতিতে; খুলনা শহরে ইমাম হুসাইন (আ.) -এর চল্লিশার শোকানুষ্ঠান আয়োজিত হয় প্রতিবছর।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত একটি দেশ। দেশটির মোট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬৫,১০০,০০০ জন। মোট জনসংখ্যার ৮৮.৩ শতাংশ মানুষ ইসলাম এবং অবশিষ্ট ১০.৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য মিল হল, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

এদেশের সংবিধান সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে স্বীয় ধর্ম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালনে পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। ১৯৮৮ সালের ২২শে এপ্রিল দেশটির সংবিধানের শুরুতে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম” যুক্ত করা হয় এবং ১৯৮৮ সালের জুন মাসের সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

নিম্নের সাক্ষাতকারটি বাংলাদেশের বিশিষ্ট ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশে আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থার (মাজমা) প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহিম খলিল রাজাভি মাজমা’র সাধারণ পরিষদের সপ্তম অধিবেশনের অবকাশে প্রদান করেন। সাক্ষাতকারটি আবনা প্রতিবেদক মোহাম্মাদ জাওয়াদ মুনেসী

 

আবনা: অনুগ্রহপূর্বক শুরুতে বাংলাদেশে আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের প্রসার কেন্দ্রীক কার্যক্রম সম্বন্ধে কিছু বলুন।

রাজাভী: বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে বিশিষ্ট মুবাল্লিগবৃন্দ তাবলিগী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ৩৮ বছর পূর্বে বাংলাদেশে একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছি, যা আজও ধর্মীয় ছাত্র প্রশিক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আল্লাহর অনুগ্রহে পঞ্চাশের অধিক ছাত্র কোম ও নাজাফের বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে এবং তাদের অনেকেই ডক্টরেট ডিগ্রি শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশে আমাদের ফজর নামে একটি পত্রিকা রয়েছে; যা সরকারের অনুমতিক্রমে বিগত ৩৫ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। একবারের জন্যেও এই পাক্ষিকের ছাপা বন্ধ হয়নি বা প্রকাশে বিলম্ব ঘটেনি এবং এটি প্রকাশের পর তা মুমিনদের নিকট, এমনকি কতিপয় সরকারি কর্মকর্তাদের হাতেও ‌আমরা পৌঁছে দিয়ে থাকি। যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে, অত্র পাক্ষিক ফিকাহে জাফরির অন্তর্গত।

আবনা: বাংলাদেশে আহলে বাইত (আ.)-এর মাজহাবের গ্রন্থ অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনাদের কতটা কার্যক্রম রয়েছে?

রাজাভী: আহলে বাইত (আ.)-এর মাজহাবের পরিচিতি প্রসারের পথে প্রয়োজনীয় গ্রন্থ অনুবাদের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এ লক্ষ্যে আলেমগণ কাজ করছেন। এ নাগাদ আমরা ৪৩টি বই বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছি। যেমন- আয়াতুল্লাহিল উযমা মাকারেম শিরাজীর লেখা "শিয়ে প-সোখ মি-দেহাদ", আয়াতুল্লাহ হাদি মারেফাতের লেখা " মাসুনিয়াত কুরআন আয তাহরিফ", আয়াতুল্লাহিল উযমা জাফর সুবহানির লেখা "মুনাযেরাতে আয়েম্মে এ মাসুমীন" ইত্যাদি।

খুলনায় অবস্থিত ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রে একটি গবেষণা বিভাগ রয়েছে; যেখানে ছাত্ররা আহলে বাইত (আ.)-এর মাজহাবের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণামূলক কার্যক্রম আঞ্জাম দিয়ে থাকে।

আবনা: ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন?

রাজাভী: এই শিক্ষাকেন্দ্রের সম্মেলন কক্ষে খুলনা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে নানাবিধ অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে রয়েছে আশুরার শোকানুষ্ঠান, ঈদে গাদির, ইরানের ইসলামি বিপ্লব বার্ষিকী, বিশ্ব কুদস দিবস ও ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী পালন ইত্যাদি।

এই শিক্ষাকেন্দ্র সংলগ্ন ইমামবাড়িতে, মাসুম ইমামগণ (আ.)-এর শাহাদাত ও জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানগুলি, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই পালিত হয়ে আসছে।

প্রশাসনের সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীর উপস্থিতিতে খুলনা শহরে ইমাম হুসাইন (আ.) -এর চল্লিশার শোকানুষ্ঠান আয়োজিত হয় প্রতিবছর।

আবনা: বাংলাদেশে আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তাকফিরিদের তৎপরতা কেমন?

রাজাভী: কয়েক বছর পূর্বে তাকফিরিরা বাংলাদেশে শিয়াদের কতিপয় প্রতিষ্ঠানে হামলা করে; যার মধ্যে হোসাইনি দালান অন্যতম। এই হামলার কারণে টেলিভিশনে আমাদের উপস্থিতিতে টক শো’ আয়োজিত হয়েছে, সরাসরি সম্প্রচারিত ঐ অনুষ্ঠান দেশের জনগণ সাদরে গ্রহণ করেছিল।

ঐ টিভি অনুষ্ঠানের পর বিভিন্ন ধর্ম (ও মাযহাবের) মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি সেমিনারে অংশ গ্রহণের আহবান জানানো হয় এবং সেখান থেকে মূলতঃ এ মেসেজটি প্রদান করা হয় যে, কোন ধর্মে উগ্রতাপূর্ণ আচরণের কোন স্থান নেই আর নিরীহ মানুষ হত্যা কোন ধর্মেই জায়েজ নয়।

ঢাকা ও রংপুর শহরে বেশ কয়েকটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাংলাদেশী শিয়া আলেমগণও বক্তব্য রাখেন; এমনকি একটি সভায় আমার বক্তব্য বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এ জাতীয় পদক্ষেপের ফলে সর্ব ধর্মের মানুষের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের শিয়াদের কেন্দ্রগুলিতে হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ওয়াহাবি চরমপন্থিদের কার্যক্রমকে নজরদারিতে রাখলে, আমাদের সমস্যাগুলি অনেকাংশেই সমাধান হবে।

আবনা: বাংলাদেশের শিয়াদের সাথে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সম্পর্ক কেমন?

রাজাভী: বাংলাদেশ সরকার এদেশের সকল ধর্মকে সহায়তা করে থাকে এবং বাংলাদেশের শিয়াদের সাথে এদেশের সকল ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর হামলা হলে গোটা দেশ সেই সংখ্যালঘুকে সমর্থন করে, আর সে কারণেই এদেশের অভ্যন্তরে কোন ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পায় না; হোক সে ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যালঘু। হিন্দু ও বৌদ্ধদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুসলমানদের বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্ব পূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশের একটি সুবিধা হচ্ছে, আমি মুসলমান আমার ঘরে আগুন লাগলে, খ্রিস্টান ভাইও দ্রুত আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এদেশে সকল ধর্মের অনুসারীরা অবাধে তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

আবনা: করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কি বাংলাদেশে শিয়াদের অনুষ্ঠানাদিকে প্রভাবিত করেছে?

রাজাভী: বাংলাদেশে করোনা অন্যান্য দেশের মতো তীব্র ছিল না এবং করোনার কারণে শুধুমাত্র স্কুলগুলো ৬ মাস বন্ধ ছিল; সেই সময়ে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

করোনার সময় বাংলাদেশে শিয়াদের অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে শুধুমাত্র শোক অনুষ্ঠানগুলি প্রভাবিত হয়েছিল এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলি সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়; তবে রাস্তায় কোন র‌্যালী অনুষ্ঠিত হয়নি। এ সময় আমরা প্রচারণামূলক কার্যক্রমের জন্য অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করেছি। উদাহরণস্বরূপ, স্বশরীরে আমাদের অনুষ্ঠানে যদি একশো লোক অংশগ্রহণ করে থাকে, তাহলে সেই অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচারে দেখা গেছে, বহু সংখ্যক মানুষ অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে অনুষ্ঠানটিতে অংশ নিয়েছে ।

ওয়াহাবিদের সংশয়ের জবাব দেওয়ার জন্য, বাংলাদেশী শিয়া যুবকেরা করোনার সময়ে দেয়া বক্তৃতা থেকে ছোট ছোট ক্লিপ তৈরি করে; পরবর্তীতে এই ক্লিপগুলি দ্রুত ব্যাপক সংখ্যায় শেয়ার হতে থাকে।

আবনা: অনলাইন প্লাটফর্মের সমস্যা বিবেচনায় বাংলাদেশে শিয়াদের জন্য এই মাধ্যম কি সুযোগ নাকি হুমকি স্বরূপ?

রাজাভী: ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে পদচারণায় অশ্লীলতার মত বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটি তরুণদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে; তাই যতই আমরা এ বিষয়ে সচেতনা তৈরির চেষ্টা করি না কেন।

কিন্তু তাই বলে এর ইতিবাচক দিকগুলি উপেক্ষা করা উচিত হবেনা। আমরা দেখেছি যে, ওয়াহাবিজমের মোকাবেলায় বাংলাদেশী শিয়া যুবকেরা নিজেদের তথ্য বৃদ্ধির জন্য অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে থাকে। এর মাধ্যমে একদিকে তারা উত্থাপিত বিভিন্ন সংশয়ের উত্তর দেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং অপরদিকে তাদের ধর্ম ও মাযহাবের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই বাংলাদেশের শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের জন্য এটি হুমকির তুলনায় সুযোগ হিসেব বিবেচ্য।

আবনা: বাংলাদেশী শিয়ারা মিডিয়া কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোন মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে?

রাজাভী: বাংলাদেশে শিয়াদের নানা বিষয়বস্তু প্রচারের জন্য আমাদের একটি সাইট রয়েছে, যার কার্যক্রম ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই পরিচালিত হচ্ছে। এই সাইটে মাজহাবী লেখনী এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ভিডিও প্রকাশিত হয়। ফজর পত্রিকার ইলেকট্রনিক সংস্করণও এই সাইটে রাখা হয়েছে এবং এই সাইটটির মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ পত্রিকার ডিজিটাল সংস্করণ সংগ্রহ ও পড়ে থাকে। এছাড়াও ইউটিউবে বাংলা ভাষাভাষী শিয়াদের জন্য আমাদের একটি চ্যানেলও রয়েছে।

আবনা: ইরানের ইসলামী বিপ্লব বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ওপর কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে?

রাজাভী: ইসলামী বিপ্লবের সুবাদে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন মসজিদমুখী এবং এদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম ধর্মীয় অনুশাসন প্রেমী; যারা সক্রিয়ভাবে জামাতে নামাজ আদায় করে থাকে।

বর্তমানে আমি যে শহরে থাকি অর্থাৎ বাংলাদেশের খুলনা শহরের শতভাগ মানুষ নামাজী এবং এই শহরের মহিলারাও হিজাব করে। ফলে খুলনার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষতি থেকে অনেকাংশে নিরাপদ।#176