আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): বহু তানজানিয়াবাসীর কাছে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা উপ-রাষ্ট্রপতি সামিয়ার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
২০২১ সালে রাষ্ট্রপতির পদে থাকা অবস্থায় মারা যান জন মাগুফুলি। তার মৃত্যুর পর সেই দায়িত্ব নেন উপ-রাষ্ট্রপতি সামিয়া। নারী হিসেবে তিনি প্রথম রাষ্ট্রপতির আসনে বসেন। তবে আগামীকাল নির্বাচনে জয়ী হলে তিনিই হবেন তানজানিয়ার প্রথম নির্বাচিত নারী রাষ্ট্রপতি। শুধু তানজানিয়া নয়, তিনিই হবেন পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলে নির্বাচিতভাবে এমন দায়িত্ব পাওয়া প্রথম নারী।
জন মাগুফুলির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল দুর্নীতির। এ ছাড়াও, স্বৈরশাসকের মতো বিরোধীদের দমনের অভিযোগ ছিল। করোনা মহামারি নিয়েও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিতর্কিত।
 
 
  কিন্তু, রাষ্ট্রপতির পদে সামিয়া বসার পর সবাই যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সংষ্কারমুখী চিন্তাধারায় সবাই মুগ্ধ হন। তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কারের পাশাপাশি দেশ পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দেন। তার এমন উদ্যোগের ফলে তানজানিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেন। তার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক হাওয়া বইতে শুরু করে।
সামিয়া তার পূর্বসূরি জন মাগুফুলির পথে না হেঁটে রাজনৈতিক ভিন্নমতকে মেনে নেওয়া ও কঠিন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ ঈসা বিবিসিকে বলেন, 'সামিয়া তার পূর্বসূরির সঙ্গে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নষ্ট হওয়া সম্পর্ক ভালো করেছেন।'
কিন্তু, জনগণকে হতাশ হতে বেশি সময় গুনতে হয়নি। মাত্র দুই বছরেই তানজানিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভীষণ নাজুক হয়ে পড়ে। সরকারের সমালোচকদের পাশাপাশি বিরোধীদলগুলোর ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জন মাগুফুলির দিনগুলোই যেন ফিরে আসে সামিয়ার শাসনামলে। দেশটিতে নিয়মিত চলছে অপহরণ-গুম ও গুপ্তহত্যা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস মনে করে, ২০২০ সালে তানজানিয়া ছিল 'আংশিক স্বাধীন' গত বছর দেশটি সেই স্বাধীনতা পুরোপুরি হারিয়েছে। যদিও দেশটির সরকার এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে নারাজ।
১৯৯২ সালে তানজানিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্র শুরুর পর থেকে সামিয়ার 'ছামা ছা মাপিনদুজি' বা সিসিএম দল প্রতিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসছে। নির্বাচনী লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোও প্রচারণা চালায় সাধ্যমত।
তানজানিয়ার আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ১৭ জন প্রার্থী হলেও প্রধান বিরোধীদল ছাদেমার প্রধান নেতা তুন্দু লিসুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার চলছে। গত এপ্রিলে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি নির্বাচন কমিশন সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলেন। এখন দলটি এর সমর্থকদের নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তানজানিয়া। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো
গত সপ্তাহে এই দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা জন হেছেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি সামিয়ার সংস্কারের বাণী 'অন্তঃসারশূন্য'। তিনি বলেন, 'সমাবেশের অনুমতি পাওয়া গেছে। কিন্তু, ছাদেমা দল সমাবেশ করতে পারে না। কারণ, সরকারে পক্ষ থেকে সংস্কারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।'
দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদল এসিটি বাজালেনদোর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী লুহানা মপিনাকে দুইবার 'অযোগ্য' ঘোষণা করা হয়। পরে উচ্চআদালতের রায়ে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান।
ছোট ছোট দলগুলো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেলেও তাদের পক্ষে সামিয়াকে পরাজিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে। আর এ কারণে অনেক নতুন ভোটার এই নির্বাচনে ভোট দিতে আগ্রহী নন।
দেশটির সবচেয়ে বড় শহর দার এস সালামের বাসিন্দা গডফ্রে লুসানা বিবিসিকে বলেন, 'আমাদের নির্বাচনে শক্তিশালী বিরোধীদল নেই। নির্বাচন ব্যবস্থাও স্বাধীন নয়। নির্বাচনের আগেই জানতে পারি কে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। ভোট দিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না। নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিই স্বাধীন হতো তাহলে ভোট দিতে উৎসাহ পেতাম।'
তবে তানজানিয়ার আধা স্বায়ত্তশাসিত জানজিবার দ্বীপের চিত্র একেবারে উল্টো। সামিয়ার বাড়ি সেই দ্বীপে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ, বিরোধীদলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখার প্রচেষ্টা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষপাতিত্ব নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে দুর্বল করে দিয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের অনাস্থা ও ভোট দিতে ভোটারদের অনাগ্রহ নির্বাচনের গুরুত্বকে আরও কমিয়ে দিয়েছে।'
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেওয়ার প্রথমদিকে ৬৫ বছর বয়সী এই নারীকে 'মা সামিয়া' বলে সম্বোধন করা হতো। সেই সুখস্মৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে তানজানিয়ার মূল ভূখণ্ডে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তখন তিনি আদেশ নয় আলোচনার মাধ্যমে দেশ চালানোর কথা বলেছিলেন।
বলা বাহুল্য, দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই প্রয়োজন। আর এর জন্য দরকার জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। একটি দেশে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলে তা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চরম প্রভাব ফেলে, যা দিনশেষে গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়।
বিশ্বব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত নগরায়নের ফলে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৩০৩ বর্গকিলোমিটারের দেশে ৩৮ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করছে। তাই তরুণ আইনজীবী ও রাজনীতিক টিটো মাগোতির দাবি খুবই সাধারণ। তিনি বলেন, 'আমরা চাই তানজানিয়ার মানুষ যেন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে। যেন স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। যা খুশি তা স্বাধীনভাবে করতে পারে।'
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন: আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তানজানিয়ার 'মা' সামিয়া সুলুহু হাসান প্রকৃত অর্থেই সবার 'প্রিয়মুখ' হয়ে উঠতে পারবেন কি? তিনি নিজ দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুনাম অর্জন করতে পারবেন কি?
সামিয়ার নির্বাচিত হওয়ার পর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ তানজানিয়ার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায় তাই এখন দেখার বিষয়।
 
             
             
                                         
                                         
                                         
                                        
Your Comment