১৫ নভেম্বর ২০২৫ - ২০:৫২
'ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক' শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম।

শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম: যিনি ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): ২০২৫ সালের জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থাড ও ইসরায়েলের আয়রন ডোমসহ বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যূহকে ভেদ দিয়ে বিশ্বের সামরিক বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।




২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনিদের ‘আল আকসা তুফান’ অভিযানও তেল আবিব ও তার মিত্রদেরকে হতভম্ভ করে দেয়।


লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের আনসারুল্লাহর সফল রকেটও বিশ্বের নজর কেড়েছে। কিন্তু এসবের নেপথ্যে কোনো রাজনীতিক নেই; কারিগর ছিলেন এক প্রকৌশলী- 'হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম'-  যাকে 'ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক' বলা হয়। তিনি জীবিত না থাকলেও তার তৈরি কৌশল ও প্রযুক্তি আজ যুদ্ধের মানচিত্র বদলে দিয়েছে।

২০১১ সালের ১২ নভেম্বর, হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম তাঁর ১৬ জন সহযোদ্ধাসহ তেহরানের পশ্চিমে মালার্দ শহরের আমিরুল-মুমিনিন ঘাঁটিতে শহীদ হন। গতকাল (বুধবার) ছিল তার ১৪তম শাহাদাতবার্ষিকী। এই নিবন্ধে আমরা তাঁর জীবন, কৌশল, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছি এবং দেখানোর চেষ্টা করেছি- কিভাবে একজন প্রকৌশলী কেবল জ্ঞান দিয়ে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছেন।

জীবন ও সামরিক অভিযাত্রা

১৯৫৯ সালে তেহরানের সারচেশমেহ্‌ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম। ১৯৭৯ সালে শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও পরবর্তীতে খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে নবগঠিত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) তরুণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তিনি।

ইরান-ইরাক যুদ্ধকালে মোকাদ্দাম রণাঙ্গন ও নেতৃত্ব দুই ক্ষেত্রেই অনন্য ভূমিকা রাখেন। দেশের আর্টিলারি ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা গড়ে তোলার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি ‘ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জনক’ খেতাব পান। ১৯৮১ সালে আবাদান মুক্তির অভিযানের পর আইআরজিসির আর্টিলারি কর্পস ও আহওয়াজ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন তিনি, যা ইরানের প্রতিরক্ষা বিকাশে মাইলফলক হয়ে ওঠে।

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি ইরাকের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে মোকাদ্দামের নেতৃত্বে ইরান নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে এবং ১৯৮৫ সালে প্রথমবার কিরকুক ও বাগদাদে সফল হামলা চালায়। পরের বছর তিনি আইআরজিসি বিমানবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বিভাগের প্রধান হন এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিট গঠনে সহায়তা করেন।

ইট-পাথর থেকে রকেট: প্রতিরোধের রূপান্তর

একসময় ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ছিল পাথর ও ইট—তবে আজ তা রকেটে পরিণত হয়েছে। হাসান তেহরানিই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর মাঝে সামরিক প্রযুক্তি ও কৌশল ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ না করে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন—এমনকি স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে রকেট তৈরি ও লঞ্চ করা শিখিয়েছেন। এই রূপান্তর একটি কৌশলগত আত্মনির্ভরতা, যা দীর্ঘমেয়াদিভাবে শত্রুকে আর্থিক ও সামরিকভাবে দুর্বল করে।

৭ অক্টোবরের হামলায় মাত্র ২০ মিনিটে ইসরায়েলে ৫ হাজার রকেট ছোঁড়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। যার একেকটি বানাতে খরচ হয়েছে মাত্র কয়েকশ ডলার। অথচ আয়রন ডোম দিয়ে সেগুলোর একেকটি ধ্বংস করতে ইসরায়েলের খরচ ৫০ হাজার ডলার করে।

'ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক' শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম।
হাসান তেহরানি মোকাদ্দামের কবরের পাশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী

জ্ঞানকে অস্ত্র বানানো: মোকাদ্দামের দর্শন

মোকাদ্দামের বিখ্যাত উক্তি—“জ্ঞানকে বোমা মেরে ধ্বংস করা যায় না”। এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন, ইসরায়েলবিরোধী ইরানি-মিত্রদের অস্ত্র দেওয়ার চেয়ে, প্রযুক্তি ভাগাভাগি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া ভালো। তাতে খরচ কম, ঝুঁকি কম, সফলতা বেশি। ঠিক সেই কাজটিই করে দেখিয়েছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা।

মোকাদ্দাম প্রশিক্ষণভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করতেন: উপকরণ-প্রতিস্থাপন, প্রোটোটাইপ ডিজাইন, ম্যানুফ্যাকচারিং, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন ও নিরাপদ লঞ্চিং পদ্ধতি শেখানো। এই 'জ্ঞান স্থানান্তর' আজ গাজা, লেবানন ও ইয়েমেনের প্রতিরোধ ইউনিটগুলোর সক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়েছে।

অর্থনীতি ও কৌশলের ভারসাম্য

যখন একটি সস্তা রকেট ঠেকাতে বহুমূল্যের প্রতিহত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়, তখন বাজেটগত ও কৌশলগত চাপ তৈরি হয়। মোকাদ্দামের কৌশল হল- ছোট ব্যয়বহুল আঘাতের ধারাবাহিকতা—যা প্রতিহত ব্যয় বাড়ায় এবং প্রতিপক্ষকে কৌশলগতভাবে ক্লান্ত করে। ফলে ইরান সরাসরি ময়দানে না থাকলেও প্রতিরোধের ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পেরেছে।

টিম মোকাদ্দাম: প্রশিক্ষণ ও ছড়িয়ে দেওয়া কৌশল

মোকাদ্দাম শুধু প্রকৌশলী ছিলেন না; তিনি একটি প্রশিক্ষণ কাঠামো গঠন করেছিলেন ‘টিম মোকাদ্দাম’ নামে। যারা ক্ষেপণাস্ত্র নকশা, উৎপাদন, লাইভ টেস্টিং ও লঞ্চ কৌশল শেখাত। এই দল লেবানন, গাজা ও ইয়েমেনে গিয়ে স্থানীয় কমান্ডারদের সঙ্গে কাজ করে কৌশলগত স্থিতি রক্ষায় ভূমিকা রাখে। ফলে স্থানীয়ভাবে রকেট উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ এখন দুর্বিষহ নয়—এটাই তার বড় অর্জন।

আন্তর্জাতিক সফর ও প্রযুক্তি অর্জন

শুরুর দিকে মোকাদ্দামের দল সিরিয়া ও লিবিয়া করে স্ক্যাড মডেলের বিশ্লেষণ; পরে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে গোপন যোগাযোগে প্রযুক্তি আরও সমৃদ্ধ করে। সেই প্রাথমিক জ্ঞান থেকেই তৈরি হয় 'নাজিয়াত' ও 'শাহাব' সিরিজের ক্ষেপণাস্ত্র—যা পরে স্থানীয়ভাবে কাস্টমাইজ করে উন্নত করা হয়।  

মোকাদ্দামের ধারণার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে উন্নত প্রযুক্তির অভেদ্য রূপ দেখা গেছে। ২০২৫ সালে ইরান ‘ফাত্তাহ’ নামে হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক সিস্টেম প্রদর্শন করে, যা বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যূহ অতিক্রম করার দাবি করে। ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ১২ দিনের যুদ্ধে শত শত ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র দখলীকৃত ভূখণ্ডে নির্ভুলভাবে আঘাত হানে এবং মার্কিন-ইসরায়েলি বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে প্রবল ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।

'ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক' শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম। মানবিক নেতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ

মোকাদ্দাম ঘাঁটিতে কাজ শুরু করার আগে সব সহকর্মীদের একত্র করে বলতেন, “আমাদের লক্ষ্য কী, শত্রু কী করছে, আর আমরা কোথায় যাচ্ছি।”

তিনি উদ্ভাবনের ওপর আস্থা রাখতেন এবং বলতেন—“আজ যদি আমরা সফল হই, তবে সেটা 'বিজ্ঞান ও ঈমানের মিলনের ফল'।”

তাঁর সহকর্মীরা আজও বলেন, যখন তিনি কোনো ঘাঁটিতে প্রবেশ করতেন, “মনে হতো এক ঝড় এসে পড়েছে—ঝড়ের মতো প্রাণশক্তি, অনুপ্রেরণা ও দায়িত্ববোধ।”

তাঁর জীবন ছিল নিখাদ সরলতা ও মানবিকতার প্রতীক। এক সহকর্মী স্মরণ করেন,

“একবার তাঁর জন্য সাইকেল কেনা হয়েছিল যাতে তিনি ঘাঁটির ভেতরে দ্রুত চলাফেরা করতে পারেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন—‘আমি সাইকেল ব্যবহার করব না, যতক্ষণ না সবাই সাইকেল পায়।’”

মোকাদ্দাম প্রতিটি সহকর্মীর ব্যক্তিগত জীবনেও মনোযোগ দিতেন—যে বিয়ে করেছে বা সন্তান জন্মেছে, তাঁদের জন্য উপহার নিয়ে যেতেন। এক শ্রমিকের গল্প এখনো ঘাঁটিতে স্মৃতির মতো বেঁচে আছে।

'ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক' শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম।
শহীদ মোকাদ্দামের কবরফলকে লেখা রয়েছে— “এখানে শুয়ে আছেন এমন একজন, যিনি ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।”

শাহাদাত ও রহস্যময় বিদায়

২০১১ সালের ১২ নভেম্বর। তেহরানের পশ্চিমে মালার্দ শহরের আমিরুল-মুমিনিন ঘাঁটিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। শব্দ এত তীব্র ছিল যে তা তেহরান ও আলবোরজ প্রদেশ পর্যন্ত শোনা যায়। সেদিনই মোকাদ্দাম ও তাঁর ১৬ জন সহকর্মী শহীদ হন। আগের দিন তিনি বলেছিলেন—“আগামীকাল আমাদের জন্য এক বিশাল দিন।” হয়তো তিনি জানতেন, সেটিই হবে তাঁর শেষ প্রস্তুতি।

তাঁর দেহ শায়িত হয় তেহরানের বেহেশত-এ জাহরা কবরস্থানের ২৪ নম্বর সেকশনে—যেখানে শহীদ মুস্তফা চামরান ও হাসান বাকেরিদের মতো বিপ্লবী কিংবদন্তিরা শায়িত।

মৃত্যুর আগে হাসান তেহরানি অনুরোধ করেছিলেন—তার কবরফলকে যেন লেখা হয়: “এখানে শুয়ে আছেন এমন একজন, যিনি ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।”  

উত্তরাধিকার: যে আগুন নিভে যায়নি

তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি থেমে যাবে। কিন্তু ঘটল তার উল্টো। তাঁর সহকর্মীরা আজ বলেন,  “হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম শহীদ হয়েছেন, কিন্তু তাঁর চিন্তা এখন শত শত মোকাদ্দামের রূপে বেঁচে আছে।”

তাঁর উত্তরসূরিরাই আজ সেই প্রযুক্তির ধারক, যা ২০২৫ সালের জুনে আমেরিকা ও ইসরায়েলের যৌথ প্রতিরক্ষা ছিন্ন করেছে। তাঁর তৈরি ‘মোবিন’ ও ‘খোররামশাহর’ সিরিজের ক্ষেপণাস্ত্র এখন ইরানের সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড।

মোকাদ্দামের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল “সাংগঠনিক আত্মনির্ভরতা”—যেখানে প্রতিটি গবেষক, সৈনিক ও কারিগরকে তিনি বলতেন, “তুমি শুধু একজন কর্মচারী নও, তুমি এই বিপ্লবের একজন সৈনিক।”

তাঁর এই দর্শনেই জন্ম নিয়েছে ইরানের আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র নেটওয়ার্ক, যা আজ প্রতিরোধ ফ্রন্টের সীমানা ছড়িয়ে দিয়েছে গাজা, দক্ষিণ লেবানন ও সানা পর্যন্ত।

উত্তরাধিকারজ্ঞান বনাম দায়িত্ব

হাসান তেহরানি মোকাদ্দামের কাহিনী কেবল একজন ব্যক্তির বায়োগ্রাফি নয়; এটি একটি কৌশলগত পাঠ। তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু প্রযুক্তি ও জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিরোধের নতুন সূচনালিপি রচনা করেছেন। তাঁর উত্তরাধিকার ‘জ্ঞানভিত্তিক প্রতিরোধ’—যা একই সঙ্গে শক্তি এবং দায়িত্ব নিয়ে আসে। হাসান তেহরানি মোকাদ্দামের মৃত্যুর পর একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে, যার নিচে লেখা ছিল একটি গভীর বাক্য— ‘শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম ইহুদিবাদী শাসনের জন্য চিরকালের দুঃস্বপ্ন।’

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha