আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): জায়নবাদী সরকার কর্তৃক দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে চালানো
হামলায় শহীদদের শাহাদাতের চল্লিশতম দিন উপলক্ষে,
গত ১২/০৫/২০২৪ যোহর-আসরের নামাজের পর শহীদ মেজর জেনারেল
মোহাম্মদ রেজা জাহেদীর পরিবার, ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতার সাথে সাক্ষাত করেন। এই সাক্ষাতে, শহীদ জাহেদীর পরিবারের উদ্দেশ্যে হজরত আয়াতুল্লাহ খামেনায়ী বলেন,
শহীদ জাহেদীর শাহাদাত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফলাফলের
কারণ হয়েছে। এতে ইসলামী
প্রজাতন্ত্র ইরানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেয়েছে এবং এর সবই হয়েছে তার শাহাদাতের
বরকতে। তিনি সৃষ্টির সর্ব নিকৃষ্টদের হাতে শহীদ হয়েছেন।
এই দিবস উপলক্ষে পশ্চিম এশিয়া স্টাডিজের গবেষক ড. এহসান কিয়ানী একটি প্রতিবেদনে, ট্রু-প্রমিস অভিযানের অর্জন, অধিকৃত ভূখণ্ডে ইরানের প্রত্যক্ষ হামলা এবং পশ্চিমা চিন্তাকেন্দ্রগুলোর বিশ্লেষণের পর্যালোচনা করেছেন।
‘ট্রু প্রমিস’ অভিযান, জায়নবাদী সরকারের সাথে ইরানের সংঘর্ষের একটি টার্নিং পয়েন্টে হিসেবে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত এবং ইরানের পক্ষের ও প্রতিরোধ ক্ষেত্রের সৈন্যদের শক্তির ভারসাম্যকে মজবুত করেছে।
দামেস্কে অবস্থিত ইরানী দূতাবাসে ইসরায়েলের সন্ত্রাসী হামলা এবং মেজর জাহেদী ও তার সাথীদেরকে হত্যা করা একটি চরম সীমালঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে ইরান পূর্বের হিসাব নিকাশ পর্যালোচনা করে ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে সরাসরি ও প্রকাশ্য পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই অভিযানে প্রায় ১২০টি ব্যলিস্টিক মিসাইল, ৩০টি ক্রুজ মিসাইল এবং ১৭০টি ড্রোন অধিকৃত ফিলিস্তিন লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয় এবং জায়নবাদী মিডিয়ার ভাষ্যমতে, অন্ততপক্ষে ৭টি ব্যলিস্টিক মিসাইল নোভাটিম বিমান ঘাঁটি সহ সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এই পদক্ষেপ, মার্কিন গবেষক ও চিন্তাকেন্দ্রগুলোর উদ্বেগের কারণ হয়েছে। এই প্রতিবেদনে, সংক্ষেপে চিন্তাকেন্দ্রগুলোর বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে এই অভিযানের অর্জনসমূহ উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘ট্রু প্রমিস’ অভিযান সম্পর্কে এই বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাকেন্দ্রগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারা, পশ্চিম এশিয়া ও ইরানের আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতি মার্কিন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সহায়ক হবে।
মার্কিন চিন্তাকেন্দ্রগুলোর সামগ্রিক আলোচনা হতে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলি ‘ট্রু প্রমিস’ অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
১) প্রতিরক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করা: উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেছেন, ‘ট্রু প্রমিস’ অভিযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হল, ইরানের প্রতিরক্ষা পুনরুজ্জীবিত হওয়া। তাদের দৃষ্টিতে ইরান এই অভিযানের মাধ্যমে সরাসরি অধিকৃত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে, সীমালঙ্ঘন করেছে এবং এর গুরুত্ব ইরান এবং জায়নবাদী সরকারের মধ্যে পূর্ববর্তী যুদ্ধের চেয়ে আরও অনেক বেশি।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মিসাইল ডিফেন্স কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ শনশেক, এই অভিযানের ব্যাপ্তির গুরুত্ব উল্লেখ করেন এবং এই ব্যাপ্তিকে (অর্থাৎ ইসরায়েলের সম্ভাব্য হতাহত এবং গ্রহণযোগ্য ক্ষয়ক্ষতিকে) ইরানের পক্ষ থেকে মনে করেন। তাই তার মতে, ইরান যে হতাহতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ রাখার দাবি করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
হাডসন চিন্তাকেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ কুনকাসাপুফ এই অভিযানকে একটি বৃহৎ, সমন্বিত এবং বহুমুখী অভিযান হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ড্রোনগুলি ইসরায়েল সরকারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করতে নিক্ষেপ করা হয় এবং যদি তেল আবিবের অংশীদারদের সহযোগিতা না থাকতো, তাহলে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে সামরিক সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারত।
আন্তর্জাতিক বিপর্যয় কমিটির ইরান বিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক আলী ওয়ায়েজের মতে, ইরানের এই অভিযান বার্তা প্রেরণে সফল ছিল; যেরূপ এই অভূতপূর্ব আক্রমণ তেল আবিবের হিসাব-নিকাশকে প্রভাবিত করেছে এবং এই সরকারকে কূটনৈতিক স্থানে হামলা না করার গাইড লাইন মানতে বাধ্য করেছে।
তেহরান এবং তেল আবিবের মধ্যকার প্রতিরক্ষার নিয়মগুলি পুনর্লিখনের কথা উল্লেখ করে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং আটলান্টিক পরিষদ চিন্তাকেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ রি-টিকিয়ে, এই হামলাকে ইসরায়েল সরকারের জন্য একটি নতুন এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতির আলামত বলে মনে করেন।
মধ্যপ্রাচ্য ইন্সটিটিউটের বিশেষজ্ঞ নিমরোদ গোরেন-এর নোটের প্রকাশিত অপর একটি বিবৃতিতে এও প্রমাণিত হয়েছে যে, ইরানের হামলা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে এবং ইসরায়েলকে এই অঞ্চলে ইরানের সামরিক সামর্থ্য নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।
২) মর্যাদার পুনরুদ্ধার: স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের এন্টিটেরোরিজম প্রোগ্রামের বিশ্লেষক ড্যানিয়েল বাইম্যান মনে করেন যে, ইরানের জন্য "‘ট্রু প্রমিস’" অভিযানের অন্যতম অর্জন হচ্ছে, তাদের মর্যাদার পুনরুদ্ধার। আইনুল আসাদে হামলার সাথে এই হামলার সদৃশতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইরান যেমন জেনারেল কাসেম সোলাইমানীর হত্যাকাণ্ডের জবাব দিয়েছে, তেমনি এবারও গুরুত্ব দিয়ে দামেস্কের তাদের দূতাবাসে জেনারেল জাহেদী ও তার সাথীদের হত্যার জবাব দিয়েছে। এভাবেই ‘ট্রু প্রমিস’ ইরানের মর্যাদা রক্ষা করেছে।
৩) ইসরায়েল সরকারের প্রতিরক্ষার পরীক্ষা: ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের সহকারী পরিচালক সুসান ম্যালোনি, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষা-কে ইরানের অন্যতম অর্জন হিসেবে মনে করেন। অন্যভাবে বললে, ইরান ইসরায়েলি সরকারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং শক্তিমত্তার দিকগুলো বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং বিষয়টি হতে ভবিষ্যতে অন্যান্য সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্রে লাভবান হবে।
৪) সফট পাওয়ার বৃদ্ধি পাওয়া: পেন্টাগনের এন্টিটেরোরিজম ইউনিটের সাবেক বিশেষজ্ঞ এবং আটলান্টিক পরিষদ চিন্তাকেন্দ্রের মধ্যপ্রাচ্য কর্মসূচির পরিচালক উইলিয়াম উইচসলার বলেন, এই অভিযান আরব বিশ্বের জনমতে ইরানের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করেছে। শিন বেট গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান নিওমি নিউম্যানও বলেছেন, এই অভিযানের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা খুবই আনন্দিত হয়েছে এবং এই অভিযান সম্পর্কে পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিন সরকারের আশ্চর্যজনক নীরবতার কারণ হচ্ছে, ফিলিস্তিনের জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে হামলার নিন্দা করার পরিণতি সম্পর্কে উদ্বেগ।
৫) কূটনৈতিক অর্জন: এই বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, ‘ট্রু প্রমিস’ অভিযান বাস্তবায়নে ইরানের অন্যতম অর্জনসমূহের একটি হচ্ছে কূটনৈতিক অর্জন; অর্থাৎ চীন ও রাশিয়ার সমর্থন অর্জন, যা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত ইরানের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আটলান্টিক পরিষদ চিন্তাকেন্দ্রের পরিচালক ফ্রেডরিক ক্যাম্প -এর মতে, হামলায় আমেরিকা সরাসরি ইসরায়েল সরকারকে সহায়তা না করায়, চীন এবং রাশিয়া খুশি হয়েছে।
হাডসন চিন্তাকেন্দ্রের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি ও নিরাপত্তা কর্মসূচির বিশেষজ্ঞ মাইকেল ডোরান এই অর্জন সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দেন যে, এই অভিযানে সফলতা পাবার পিছনে ইরান, তাদের অভিযানকে পিছিয়ে দেয়া এবং দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি সরকারের হামলায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ হতে নিন্দা প্রস্তাব না আসার প্রতি ঋণী।
এই কূটনৈতিক সফলতা, আমেরিকার পিছু হটার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে; যা বাইডেন সরকারকে যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তিত করতে এবং মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিকে দুই ধাপে তেল আবিবকে নিয়ন্ত্রণ করাতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, ইরানের অভিযানের পূর্বে জায়নবাদী সরকারকে আগাম হামলা প্রতিরক্ষার প্রতি সতর্ক করে এবং দ্বিতীয়ত, ইরানের অভিযানের পর এই সরকারকে বড় ধরনের প্রতিশোধ না নেবার বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে।
তিনি ইরানের হামলায় চীন ও রাশিয়া কর্তৃক নিন্দা না জানানোকে, ইরানের কূটনৈতিক সাফল্যের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কোন পরিণতি ছাড়াই ইরান সরাসরি ইসরাইলকে আঘাত করতে সক্ষম।
পরিশেষে বলা যায় যে, ইরান ও প্রতিরোধ ফ্রন্টের ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের পদক্ষেপ হিসাবে ‘ট্রু প্রমিস’ অভিযান পরিচালনা, ঐশী বানীর একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ (واعِدّوا لَهُم مَا استَطَعتُم مِن قُوَّةٍ)। ইরান বুদ্ধিকরে ও উদ্দেশ্য নিয়ে, এই অভিযানে চমকপ্রদ ও বহুপাক্ষিকতার মত দুটি উপাদান ব্যবহার করেনি এবং তারা তাদের সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী অস্ত্রের ব্যবহার করেনি, যাতে এই অভিযানের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত প্রভাব তৈরি না করে, রাজনৈতিক বার্তা প্রেরণ করতে পারে।
এইভাবে, সামরিক শক্তি প্রদর্শন এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দখলদার সরকার এবং জায়নবাদী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক গুরুতর আঘাতের জন্য ইরানের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ, আমেরিকা এবং এই সরকারের পশ্চিমা মিত্রদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সাথে এই সরকারের প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘর্ষের ধারাবাহিকতা এবং ইরানী বাহিনীকে হত্যা, বিশেষ করে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কূটনৈতিক নিরাপদ স্থানগুলির প্রতি তেল আবিবের অবহেলা, তাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনবে।
এই বিষয়টি বিশেষকরে, একচোখ ইউক্রেন ফ্রন্টে এবং অন্যটি চীনকে নিয়ন্ত্রণের দিকে থাকা হোয়াইট হাউজের জন্য আরও বেশি চিন্তার কারণ হয়েছে, যা এই চিন্তাকেন্দ্রগুলোর বিশেষজ্ঞদের লেখনীতে ফুটে উঠেছে এবং তারা মার্কিন সরকারকে গাজা যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টা করতে এবং ‘ট্রু প্রমিস’ অভিযানের সম্ভাব্য ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন।
এই বিষয়টি তুলে ধরেছে যে, আমেরিকা ও ইসরায়েল, ইরানের সাথে যুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে যারা ভীতি ছড়াচ্ছে, তাদের ভাবনার বিপরীতে বাস্তবতা হচ্ছে; ভূ-রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক পরিবেশ এবং তাদের অর্থনৈতিক উৎসসমূহের অবস্থা এজাতীয় যুদ্ধে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট নয়। অতএব, তাদের লক্ষ্য ইরানের মাটিতে সরাসরি আক্রমণ নয়, বরং বিভিন্ন আঞ্চলিক, প্রতিরক্ষামূলক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করা। তারা একদিকে ইরানের জনমতের বিরুদ্ধে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, এর জন্য তৎপর হয়েছে।
অতএব, ট্রু-প্রমিস অভিযানের অর্জনসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বৈদেশিক নীতি এবং অর্থনৈতিক সংস্থাগুলির স্বয়ংক্রিয়তার প্রয়োজনীয়তা, এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জোটকে দুর্বল করতে এবং ইরানী জাতির জীবিকার উন্নয়নের জন্য অনস্বীকার্য।#176