২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ১২:৩০
৩৮ দিনে ইসরায়েলি সেনাদের অভিযানে ৩৫৪২ ফিলিস্তিনি নিহত

ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত স্থল অভিযানে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩৮ দিনে ইসরায়েলি সেনাদের অভিযানে মোট ৩,৫৪২ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): গড় হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ৯৩ জন করে বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আই বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরেছে।



সরকারি মিডিয়া অফিসের বিবৃতি অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ১,৯৮৪ জন বা ৫৬ শতাংশ মানুষ উত্তর গাজা উপত্যকার বাসিন্দা। বাকিরা, অর্থাৎ ১,৫৫৮ জন (৪৪ শতাংশ), প্রাণ হারিয়েছেন মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলকেই ইসরায়েল ‘নিরাপদ মানবিক অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ঘোষিত সেই নিরাপদ এলাকাও ইসরায়েলি গোলাবর্ষণ থেকে মুক্ত নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ স্পষ্টতই কৌশলগত। উত্তর গাজায় নির্বিচারে হামলা চালিয়ে বাসিন্দাদের জোরপূর্বক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হচ্ছে। পরে সেই বাস্তুচ্যুত মানুষদের লক্ষ্য করে আবার মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলকে আঘাত করা হচ্ছে। ফলে গাজাজুড়ে কোথাও প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা নেই।

গাজার মিডিয়া অফিস তাদের বিবৃতিতে নিহতদের সংখ্যা এবং লক্ষ্যস্থলের বর্ণনা দিয়ে ইসরায়েলের অভিযানের প্রকৃতি তুলে ধরেছে। তারা বলছে, এ ধরনের হামলা কেবল সামরিক অভিযান নয়, বরং একটি ‘পদ্ধতিগত গণহত্যার নীতি’র অংশ।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি—সব মিলিয়ে এটি সরাসরি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাবনাও এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপেক্ষিত হচ্ছে।

মিডিয়া অফিস অভিযোগ করেছে, ইসরায়েলি বাহিনী বেসামরিক এলাকাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিশানা করছে। স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী ক্যাম্প, এমনকি ঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্রও হামলার বাইরে থাকছে না। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, ইসরায়েলি সেনারা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যই এ ধরনের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।

গাজার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জরুরি আহ্বান জানানো হয়েছে। তাদের দাবি, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে অবশ্যই দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধ বন্ধে কেবল নিন্দা নয়, বরং বাস্তব পদক্ষেপ জরুরি। ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহির আওতায় আনা ছাড়া এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ ঠেকানো সম্ভব নয়।

অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে গাজার পরিস্থিতি দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়ায় লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকট চরমে পৌঁছেছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম এবং জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী প্রায় শেষ পর্যায়ে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, যদি এই হামলা অব্যাহত থাকে, তাহলে গাজা কার্যত একটি ‘মৃত্যুপল্লী’তে পরিণত হবে। শিশু ও নারীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ নাগরিক যেভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন, তা ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েলের এই স্থল অভিযান কেবল সামরিক কৌশলের অংশ নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড থেকে দীর্ঘমেয়াদে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পর্কিত। উত্তর গাজা প্রায় জনশূন্য করার পর মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলেও একই কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ইসরায়েলকে আরও উৎসাহিত করছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, যদি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে গাজার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র চিরতরে বদলে যেতে পারে।

মাত্র ৩৮ দিনে গাজায় সাড়ে তিন হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়া একটি মর্মান্তিক বাস্তবতা। প্রতিদিন প্রায় একশ মানুষের মৃত্যু শুধু সংখ্যা নয়, বরং একেকটি পরিবার, একেকটি স্বপ্নের ধ্বংস। এ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে—শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে কি মানবতা একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে?

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha