‘আহলে বাইত বার্তা সংস্থা’

সূত্র : ABNA
বৃহস্পতিবার

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

২:৫৬:১৮ AM
1396314

ইমাম মাহদী (আ.ফা.); সর্বশেষ হুজ্জাত এবং সর্ববৃহৎ ঐশী নেয়ামত

অন্তর্ধানকালের ফিৎনা থেকে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল দ্বীনের প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা; যে দ্বীনে রয়েছে নিষ্পাপ ইমামগণের (আ.) অভিভাবকত্ব এবং তাদের সাহচর্য।

 আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): ৯ই রবিউল আওয়াল, ইমাম মাহদী (আ.ফা.) -এর ইমামত ও বেলায়াতের দায়িত্ব গ্রহণ এবং শিয়াদের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সূচনার কারণে স্মরণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইমাম হাসান আসকারী (আ.) অন্যান্য নিষ্পাপ ইমামগনের পদ্ধতি মোতাবেক ইমাম মাহদী (আ.) -এর ইমামত এবং তাঁর অন্তর্ধানকালীন সময়ের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। বিশ্বস্ত বর্ণনানুসারে তাঁর শাহাদাতের আগের রাতে, খলিফা কর্তৃক নিয়োজিত পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, শিয়া বসতিপূর্ণ একাধিক শহরে পত্র প্রেরণ করে শিয়াদেরকে চলমান সংবেদনশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন।

হাদিসে দ্বাদশ ইমামের জন্মগ্রহণ সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ বানী থাকায় আব্বাসীয় হুকুমত অনেক আগে থেকেই ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) উপর দৃষ্টি রেখে আসছিল; কিন্তু একাদশ ইমাম (আ.) তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখা এবং তা অল্প সংখ্যক বিশেষ সাহাবিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন। একাদশ ইমামের শাহাদাতের পর মাহদী (আ.) নামক তাঁর একটি সন্তানের জন্মের খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং ইমাম মাহদীকে (আ.ফা.) খুঁজে পাওয়ার জন্য আব্বাসীয় খলিফাদের একাধিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

 

ইমামতের মূলনীতি

ইসলামের ইতিহাসে সর্বদাই রসূলে আকরামের (সা.) পরবর্তী উত্তরাধিকার তথা ইমামতের বিষয়টি মুসলমানদের মধ্যে আকিদাগত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়েছে। শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে, আসমানি কিতাব নাযিল হওয়া এবং নবী-রসূল প্রেরণ করার উদ্দেশ্য তখনই পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে যখন নবুয়্যতের ধারার সমাপ্তি একজন নিষ্পাপ ইমাম মনোনয়নের ঘটবে। একজন ইমাম শুধুমাত্র ওহী গ্রহণ ব্যতীত একজন নবীর সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যা মানুষকে বেলায়াতে তাকভিনী (সৃষ্টি জগতে তসরুফ করার ক্ষমত সংশ্লিষ্ট), বেলায়াতে তাশরিয়ী (শরিয়ত সংশ্লিষ্ট) এবং বিদ্যমান ঘাটতি দূর করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছানোর পথে ভীত তৈরি করে।

 

ইসলামে খেলাফত ও ইমামতের বিষয়টি, শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও ব্যক্তির যোগ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে বয়সের কোন প্রভাব নেই। যেরূপ, ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্ন থেকেই, আমিরুল মুমিনিন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) অল্পবয়স্ক থাকা অবস্থায় রসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক তাঁর অভিভাবকত্ব, ইমামত ও উত্তরাধিকারী হবার বিষয়ে ঘোষণা দিয়ে এসেছেন।

 

ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর শাহাদাতের পর সামেরা শহর যখন তাঁর ভক্তদের আগমনে ভরে গেল, তখন তাঁর ভাই জাফর একাদশ ইমামের জানাজার নামাজের ইমামতির জন্য এগিয়ে আসে, কিন্তু বিশ্বস্ত বর্ণনানুযায়ী বিশেষ করে শেইখ সাদুকের বর্ণনায়, স্বয়ং ইমামে জামান (আ.ফা.) তাঁর চাচা জাফরকে সরিয়ে নিজের সম্মানিত পিতার জানাজার নামাজে ইমামতি করেন এবং এটি ইমামে জামান (আ.ফা.)-এর ইমামত ও অভিভাবকত্বের অন্যতম আলামত; কিন্তু অন্তর্ধানকালের সূচনার মাধ্যমে যুগের ইমামের (আ.ফা.) সাথে শিয়াদের যোগাযোগ বিশেষ প্রতিনিধিগণের মাধ্যমে সংঘটিত হত এবং এই সময় থেকেই শিয়ারা গাইবাতের স্বাদ গ্রহণ করে।

 

হযরত মাহদী (আ.ফা.) -এর ইমামত

পয়গম্বরে আকরাম (সা.) বিভিন্নভাবে হযরত মাহদী (আ.ফা)-এর ইমামতের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন এবং তাঁর জন্ম, জীবন ব্যবস্থা ও তাঁর শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানিয়ে গেছেন। একটি বর্ণনায়, রসুল (সা.) আলী (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন: আমার পরবর্তী ইমাম হবেন বারোজন; যাদের প্রথম হলে তুমি এবং সর্বশেষ হল কায়েম, যার হাতে মহান আল্লাহ্ দুনিয়ার পূর্ব থেকে পশ্চিমের বিজয় দান করবেন। (সাদুক, আমালী, পৃষ্ঠা ১৭৩) একইভাবে অপর এক স্থানে বলেন: এই ইমামগণের নবম ব্যক্তি হলেন (ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বংশধারায় নবম ব্যক্তি), আমার আহলে বাইতের কায়েম এবং এই উম্মতের হেদায়াতকারী (মাহদী), মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাঁর আচার-আচরণ ও কথা-বার্তা আমার সাদৃশ্য। সে এক সুদীর্ঘ অন্তর্ধানকাল, বিস্ময়কর ও দিশাহারা পরিস্থিতির শেষে আত্মপ্রকাশ করবে এবং আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করবে। সে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্রমাগত সমর্থন ও সহযোগিতায় পৃথিবীকে ততটাই ন্যায়বিচারে পূর্ণ করবে, যতটা তা জুলুম ও অত্যাচারে পূর্ণ থাকবে। (সাদুক, কামালুদ্দীন ওয়া তামামুন নে’য়মা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৫৭)

তাই আব্বাসীয় খলিফাদের কর্তৃক সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কারণে হযরত মাহদী (আ.ফা) তাঁর জন্মের পর থেকে একটি সময়কাল পর্যন্ত অর্ধ-লুকায়িত অবস্থায় জীবন যাপন করেন। এই সময়কালে, যা ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর শাহাদাত পর্যন্ত দীর্ঘায়ত ছিল, খুবই অল্প সংখ্যক শিয়া তার সাক্ষাৎ লাভ করতে সক্ষম হয়। এরপর থেকেই মূলতঃ দ্বাদশ ইমামের জীবনের সংকটময় অধ্যায়ের সূচনা হয়, যা গায়বাতের যুগ তথা অন্তর্ধানকালীন সময় হিসেবে প্রসিদ্ধ।

হযরত মাহদী (আ.ফা.) কর্তৃক ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর জানাজায় ইমামতির বিষয়টি জনগণের দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে, যা ইমামত সংক্রান্ত বিষয়ে ভবিষ্যতে বিচ্যুতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর এই বিষয়টি সকল শিয়াদের নিকট স্পষ্ট করে দেয় যে, ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর পর তাঁর সন্তান ইমামতের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। এর মাধ্যমে, শিয়া মাজহাবকে সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আব্বাসীয় খলিফাদের ভয়ানক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়।

ইমামের ইমামতির সূচনা, আল্লাহর ইচ্ছা এবং অন্যান্য পরিস্থিতির কারণে অন্তর্ধানের মধ্য দিয়েই ঘটেছিল। যা গাইবাতে সোগরা (স্বল্পমেয়াদি অন্তর্ধান) নামে প্রসিদ্ধ। এই গাইবাতকাল হিজরি ৩২৯ সন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। এরপর থেকে অন্তর্ধানের নতুন মাত্রার সূচনা হয় যা গাইবাতে কোবরা (দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধান) নামে প্রসিদ্ধ। এই অন্তর্ধানকে কেন্দ্র করে রেওয়ায়েতে অনেক ব্যাখ্যা এসেছে যেগুলি অনেক অত্যন্ত বিপজ্জনক ফিৎনা সংঘটিত হবার বিষয়ে খবর দেয়।  এই সময়ের মানুষেরা ঐশী ও মানবিক মূল্যবোধকে অবহেলার কারণে আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর, সজ্জিত এবং আধুনিক জীবন থাকা সত্ত্বেও উদ্বিগ্ন ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে এবং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও দর্শন হারানোর হতাশায় পতিত হবে।

প্রকৃত ইসলামী সংস্কৃতিতে, এমন পরিস্থিতি হতে বাঁচতে, আল্লাহর রসুল (সা.) এবং নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) হতে "অন্তর্ধানকালীন কর্তব্য" শীর্ষক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে। এই বিষয়গুলির পালন করার অর্থ বিচ্যুতির ঝুঁকি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা; কেননা খোদায়ী হুকুম না মানা এবং সঠিক আকিদা ও চিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকা, শেষ যুগের ফিৎনায় আক্রান্ত হবার অন্যতম কারণ।

 

শেষ যুগের ফিৎনা থেকে বাঁচতে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত একটি সমাধান

অন্তর্ধান কালের ফিৎনা থেকে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল দ্বীনের প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা; যে দ্বীনে রয়েছে নিষ্পাপ ইমামগণের (আ.) অভিভাবকত্ব এবং তাদের সাহচর্য। ইমাম হাসান আসকারী (আ.) বলেন: আল্লাহর শপথ, (আমার পুত্র!) এমন এক অন্তর্ধান পার করবে যার ফলে কেউ মৃত্যু (বেদ্বীন ও পথভ্রষ্টতা) থেকে পরিত্রাণ পাবে না শুধুমাত্র তারা ব্যতীত যাদেরকে আল্লাহ ইমামতের প্রতি বিশ্বাস ও আকিদার মাধ্যমে দৃঢ়তা দান করেছেন এবং তাদেরকে তাঁর (ইমামের) আত্মপ্রকাশের দ্রুততার জন্য দোয়া করার তৌফিক দান করেছেন। (সাদুক, মুহাম্মদ বিন আলী, কামালুদ্দীন ওয়া তামামুন নে’য়মা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৮৪)

অতএব যদি পরিত্রাণের একমাত্র পথ সেই দ্বীন হয়, যে দ্বীনের পাঠ্যে আল্লাহর কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবকের অভিভাবকত্বকে মেনে চলতে বলা হয়েছে, তাহলে এর প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে প্রতিটি যুগে একজন আল্লাহর হুজ্জাত ও ইমাম নির্ধারিত থাকবেন, যাতে মানুষ তার সাহচর্য লাভ করতে পারে এবং আনুগত্য করতে পারে। যেরূপ ইমাম মাহদী (আ.ফা.) এক তৌকী (লিখিত বার্তা)-তে উসমান ইবনে সাইদ আমরিকে (রহ.) বলেন: পৃথিবী কখনোই আল্লাহর হুজ্জাত বিহীন থাকবে না; হোক তা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য। (কুতুব রাওয়ান্দি, সাইদ বিন হিবাতুল্লাহ, আল-খারায়েজ ওয়াল জারায়েহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১১১০, হাদিস ২৬।)#176A