'ইহুদি জাতি' ধারণার ঐতিহাসিক বাস্তবতা:
ইসরাইলের ইতিহাসবিদ শ্লোমো স্যান্ড-এর মতে, ফিলিস্তিনে আসা ইহুদি অভিবাসীদের কোনো একক পূর্বপুরুষ ছিল না। বরং তাদের অনেকেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ে ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, 'ইহুদি জাতি' ধারণাটির কোনো বাস্তব ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, বরং এটি একটি আধুনিক আদর্শিক নির্মাণ, যা ইউরোপীয় খ্রিস্টান, বিশেষত প্রোটেস্টান্টদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। এই বিশ্বাস—ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে প্রত্যাবর্তন ঘটলে খ্রিস্টের পুনরাগমন ও পৃথিবীর সমাপ্তি ঘটবে—একটি ধর্মীয়-রাজনৈতিক ভাষ্যে রূপ নেয়।
ইংরেজ ধর্মযাজক টমাস ব্রাইটম্যান ছিলেন প্রথম যারা প্রকাশ্যে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে ফিরে আসার দাবি করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরে শাতোব্রিয়াঁ ও নেপোলিয়নের মতো চিন্তাবিদদের লেখায়ও প্রতিফলিত হয়। নেপোলিয়ন মধ্যপ্রাচ্যে তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনায় ইহুদিদের সমর্থন লাভের জন্য তাদের ফিলিস্তিনে ফেরার ধারণাকে ব্যবহার করেছিলেন।
ব্রিটিশ ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ:
১৯ শতকে, অ্যান্থনি অ্যাশলে কুপার (আর্ল শ্যাফটসবারি) প্রথম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ যিনি প্রকাশ্যে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে ফিরিয়ে আনার ধারণা প্রচার করেছিলেন। তিনি "দ্য স্টেট অ্যান্ড দ্য রিস্টোরেশন অফ দ্য জিউস" শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন যে, ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে ফিরে আসা উচিত এবং এটি যীশুর পুনরাগমনের সূচনা করবে। তিনি এই লক্ষ্যে তার পারিবারিক প্রভাব ব্যবহার করেছিলেন, কারণ তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টন-এর জামাতা ছিলেন। ১৮৪০ সালে পামারস্টন কনস্টান্টিনোপলে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে, ইহুদিদের ফিরে আসা অটোমানদের জন্য উপকারী হবে, কারণ এটি সম্পদ ও উন্নয়ন বয়ে আনবে।
ব্রিটিশ ও জায়নবাদী প্রকল্প:
১৮৩৮ সালে, জেরুজালেমে প্রথম ব্রিটিশ কনস্যুলেট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার অঘোষিত মিশন ছিল ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনকে উৎসাহিত করা এবং তাদের রক্ষা করা। জেরুজালেমের ব্রিটিশ কনসাল জেমস ফিন, প্রকাশ্যে ইহুদি বসতি স্থাপন ও ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার মধ্যে সম্পর্কের কথা বলেছিলেন। তিনি ১৮৪৫ থেকে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন এবং পরবর্তীতে জায়নবাদী ইতিহাসবিদদের মাধ্যমে ইহুদি অভিবাসন প্রকল্পে তার সমর্থনের জন্য প্রশংসিত হন।
এই সময়েই, ফিলিস্তিনে টেম্পল মুভমেন্ট নামক একটি খ্রিস্টান জার্মান গোষ্ঠী তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তারা বিশ্বাস করত যে, ইহুদি মন্দির পুনর্নির্মাণ যীশুর ফিরে আসাকে ত্বরান্বিত করবে। তারা ১৮৬৬ সালে হাইফার কার্মেল পর্বতে তাদের প্রথম বসতি স্থাপন করে এবং পরে সমগ্র ফিলিস্তিনে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের উপনিবেশায়ন পরবর্তীতে জায়নবাদী অভিবাসীদের জন্য একটি মডেল হয়ে ওঠে। জার্মান গবেষকরা এই কার্যক্রমকে "নীরব ক্রুসেড" বলে অভিহিত করেছেন।
ইহুদি অভিবাসনের তরঙ্গ:
১৮৮২ সালে, ফিলিস্তিনে প্রথম জায়নবাদী ইহুদি অভিবাসনের ঢেউ শুরু হয়, যা জায়নবাদী আলোচনায় প্রথম আলিয়া নামে পরিচিত। এই তরঙ্গে মূলত পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদি অভিবাসীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় তরঙ্গ ১৯০৪ সালে শুরু হয় এবং সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট মতাদর্শের ইহুদি অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত ছিল।
জায়নবাদীরা ধীরে ধীরে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাঠামো গড়ে তোলে, কিন্তু তাদের কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে বিশ্বশক্তির সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। এই সমর্থন ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণা-এর মাধ্যমে এসেছিল। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি লর্ড রথচাইল্ড-কে একটি চিঠিতে জানান যে, ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে।
তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ একজন উৎসাহী প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইহুদিদের ফিলিস্তিনে ফিরে আসা যীশুখ্রিস্টের পুনরাগমনের সূচনা করবে। তিনি ও অন্যান্য ব্রিটিশ নেতারা ধর্মীয় ও কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিনকে দেখেছিলেন। তারা একটি মুসলিম উপনিবেশের চেয়ে একটি ইহুদি উপনিবেশকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
এইভাবে, জায়নবাদ, যা শুরুতে ইহুদিদের মধ্যে একটি সংখ্যালঘু আন্দোলন ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে একটি রাজনৈতিক ও ঔপনিবেশিক প্রকল্পে পরিণত হয়।
মৌলিক প্রশ্নগুলো থেকে যায়:
এই অভিবাসীরা কি সত্যিই সেই ইহুদিদের বংশধর ছিল যাদের দুই হাজার বছর আগে ফিলিস্তিন থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল? ইসরাইলের বিজ্ঞানীদের প্রাচীন ইহুদি ও নতুন অভিবাসীদের মধ্যে জিনগত সংযোগ প্রমাণের প্রচেষ্টা এখনও এই দাবিকে জোরালোভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।
আরেকটি প্রশ্ন: এই অভিবাসীরা কি সত্যিই একটি জাতি ছিল?
মনে হয়, ফিলিস্তিনে আসা ইহুদি অভিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবে কোনো একক, ভূমিদাবিদার জাতি ছিল না, বরং এটি ছিল ঔপনিবেশিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে আধুনিক জাতি-নির্মাণের একটি "আবিষ্কৃত" ধারণা। ফিলিস্তিন না ছিল জনশূন্য, আর না ছিল কোনো "ভূমিহীন জাতি"-এর প্রয়োজন। বরং এটি একটি ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছিল, যা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কল্পকাহিনির মাধ্যমে ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছিল।#
Your Comment