১০ নভেম্বর ২০২৫ - ০৩:৪১
জাতিসংঘ: সুদানের এল-ফাশেরে ‘অকল্পনীয় নৃশংসতা’ চলছে।

এল-ফাশেরে, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় হুশিয়ারি দিয়েছে, ওই অঞ্চলে 'সহিংস হামলার' সংখ্যা এখনো বাড়ছে।


অকল্পনীয় নৃশংসতা

গত শনিবার সামাজিক মাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে সুদানে নিযুক্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিনিধি লি ফুং এক ভিডিওতে বলেন, 'গত ১০ দিনে এল-ফাশেরে সহিংসতার মাত্রা অনেক বেড়েছে। এটি এখন একটি দুঃখ-দুর্দশার নগরী।' 

'যেসব বেসামরিক মানুষ কোনোমতে গত ১৮ মাসের নিরবচ্ছিন্ন হামলা ও বৈরি পরিবেশের মধ্যে টিকে ছিলেন, তারা এখন অকল্পনীয় মাত্রার নৃশংসতা সহ্য করছেন', যোগ করেন লি। 

এল ফাশের থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন সুদানিরা। ছবি: রয়টার্স
এল ফাশের থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন সুদানিরা। 

তিনি আরও বলেন, 'নারী, শিশু ও আহতসহ হাজারো মানুষ নিহত হয়েছেন। তারা হাসপাতাল ও স্কুলে আশ্রয় নিয়েও প্রাণে বাঁচতে পারেননি। হামলা থেকে পালাতে গিয়ে অনেক পরিবারের সব সদস্য নিহত হয়েছেন। অনেক মানুষের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।'

সুদান'স আইডিপি অ্যান্ড রিফিউজি ক্যাম্প নামের মানবাধিকার সংস্থার মুখপাত্র আদম রোজাল বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, এল-ফাশের থেকে পালিয়ে ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষ তাউইলায় এসেছেন।

ত্রাণসংস্থাটির প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা যায়, অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। কিছু পরিবার ছেঁড়া কাপড়, বিছানার চাদর ও অন্যায় উপকরণ জোড়াতালি দিয়ে তাঁবু বানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু সেগুলোর অবস্থাও খুবই জীর্ণ।

নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের (এনআরসি) সুদান শাখার অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার ম্যাথিলডে ভু এএফপিকে বলেন, অনেক তাউইলায় আসা অনেক পরিবারের সঙ্গে শিশুরা এসেছে, কিন্তু তারা তাদের সন্তান নন।

'এর অর্থ হলো, তারা আসার সময় বাবা-মা হারা অসহায় শিশুদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ওই শিশুদের বাবা-মা হারিয়ে গেছে, আটক হয়েছে অথবা নিহত হয়েছে', যোগ করেন ভু।

এল-ফাশেরের পতন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ও বর্তমান পরিস্থিতি

২৬ অক্টোবর দারফুর রাজ্যের এল-ফাশের সরকারী সেনাবাহিনীর শেষ ঘাঁটির পতন হয় এবং আরএসএফের হাতে রাজ্যের নিরঙ্কুশ আধিপত্য চলে যায়। সেদিন থেকেই এল-ফাশেরের বাসিন্দারা তাউইলাসহ অন্যায় শহরে পালিয়ে যেতে শুরু করেছেন।

২৮ অক্টোবর ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক গবেষণা ল্যাবের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবির তথ্য মতে, এল-ফাশেরে গণহত্যা চালিয়েছে আরএসএফ। ছবিতে বিভিন্ন জায়গায় রক্তের বন্যা বইতে দেখা যায়।

৪ নভেম্বর পর্যন্ত তাউইলা, কেবকাবিয়া, মেলিত ও কুতুম শহরে ৮২ হাজারেরও বেশি মানুষ পালিয়ে এসেছেন বলে ধারণা করছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।

আরএসএফের হাতে দখল যাওয়ার আগে এল-ফাশেরের জনসংখ্যা ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার।

এল-ফাশের দখলের পর আরএসএফের সেনাদের উল্লাস। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
এল-ফাশের দখলের পর আরএসএফের সেনাদের উল্লাস। 

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ফলকার তুর্ক শুক্রবার জানান, এল-ফাশের থেকে বেসামরিক মানুষকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, 'আমি আশঙ্কা করছি, শহরের ভেতর এখনো নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত সহিংসতার মতো নিন্দনীয় নৃশংসতা অব্যাহত রয়েছে।'

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, সরকারী বাহিনী ও আরএসএফের সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। ত্রাণসংস্থাগুলোর দাবি, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

দুই বিবদমান পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে চার দেশের একটি মধ্যস্থতাকারী জোট কাজ করছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে 'কোয়াড' নামে পরিচিত এই জোটে আছে মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র।

গত বৃহস্পতিবার কোয়াডের তিন মাসের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে আরএসএফ।

তবে পরের দিনও খার্তুম ও উত্তরের আতবারা নগরীতে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। উভয় শহর এখনো সেনাবাহিনীর দখলে আছে।

প্রস্তাব মতে, 'তিন মাসের মানবিক যুদ্ধবিরতি' শেষে স্থায়ীভাবে দেশটির সংঘাতের নিরসন হবে এবং পরবর্তীতে বেসামরিক ও রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।  

উল্লেখ্য, এখনো রাজধানী খার্তুমসহ সুদানের উত্তরাঞ্চল, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে আছে।

স্যাটেলাইট ছবিতে এল-ফাশেরের ধ্বংসযজ্ঞ। ছবি: এএফপি
স্যাটেলাইট ছবিতে এল-ফাশেরের ধ্বংসযজ্ঞ।

শনিবার দারফুরের গভর্নর মিন্নি আরকো মিন্নাউই এক্সে বলেন, 'যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে আরএসএফের সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি স্পষ্ট না হলে তা কার্যকর হবে না, বরং বিভাজন আরও বাড়বে।'

এল-ফাশেরের পতনের ফলে সুদানের পশ্চিমের সুবিশাল ভূখণ্ডের পাঁচটি রাজ্যের রাজধানীর দখল আরএসএফের হাতে চলে আসে। যার ফলে, কার্যত দেশটি এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান-এর নেতৃত্বাধীন সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) বিরুদ্ধে লড়ছে তারই এক কালের সহযোগী ও 'বন্ধু' মোহামেদ হামদান 'হেমেতি' দাগালো-এর আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা অন্তত দেড় লাখ।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, এই সংঘাতে দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি মানুষ। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ।

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha