২ নভেম্বর ২০১৯ - ০৮:৩০
বিশ্বের সর্ববৃহত পদযাত্রা আরবাঈনের কিছু পরিসংখ্যান

কারবালার ঐ ৭২ শহীদের শাহাদাতবার্ষিকীর ৪০ তম দিবস উপলক্ষে এ পদযাত্রা। যার ইতিহাস বহু পুরোনো। কারো কারো মতে এর ইতিহাস ইমামদের যুগেই প্রত্যাবর্তন করে।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): মহানবি (স.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ.) এর পবিত্র শাহাদাতের চল্লিশার অনুষ্ঠানে প্রতিবছরের ন্যায় চলতি বছরও যোগদান করেছে বিপুল সংখ্যক আহলে বাইত প্রেমী। হয়তবা অনেকেই ধারণা করেন এতে শুধুমাত্র শিয়া মুসলিমরাই অংশগ্রহণ করে থাকে কিন্তু তাদের ধারণার উর্ধ্বে বিপুল সংখ্যক সুন্নি মুসলিমসহ খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বিরাও অংশগ্রহণ করে থাকেন মহান এ পদযাত্রায়।

শুধুমাত্র ইরাক থেকে নয়, প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত যায়েররা ইমাম হুসাইন (আ.) এর প্রতি শোক নিবেদন করতে কারবালায় উপস্থিত হন। যে সংখ্যক মানুষ এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করছে তা বিশ্বের ইতিপূর্বের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

আদিকাল থেকে এ পদযাত্রার প্রচলন থাকলেও স্বৈরাচারী সাদ্দাম সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পদযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বেধে দেয়া হয় নবি (স.) এর দৌহিত্রের কবর যেয়ারতের উপরও বিভিন্ন বিধি-নিষেধ। কিন্তু সাদ্দামের মৃত্যুর পর পূনরায় পথ উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয় এবং মানুষ আগের চেয়েও অধিক আগ্রহ নিয়ে এ পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে থাকে। প্রতি বছর বাড়তে থাকে যায়েরদের সংখ্যা।

কেন এই পদযাত্রা?

৬১ হিজরীতে উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের (আল্লাহর লানত তাদের উপর বর্ষিত হোক) সুসজ্জিত সুবিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ইরাকের কারবালা প্রান্তে ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর ৭১ জন সাথী; যাদের মাঝে তার সন্তান, ভাতিজা, ভাগ্না, ভাই, সাথীরা ছিলেন শাহাদত বরণ করেন। সেই শাহাদাতের ঠিক ৪০ দিন পর আল্লাহর নবি (স.) এর মহান সাহাবী হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আনসারি (রা.) কারবালায় অবস্থিত ইমাম হুসাইন (আ.) এর সমাধি যেয়ারত করতে আসেন। তিনি প্রথম ফুরাতের পানিতে নেমে গোসল করেন এরপর পরিচ্ছন্ন কাপড় করে ইমাম হুসাইন (আ.) এর মাজার যেয়ারত করেন। ইমাম হুসাইন (আ.) এর মাজারকে জড়িয়ে ধরে তিনি ক্রন্দন করেন।

এছাড়া পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে মহানবি (স.) এর বন্দি পরিবার তথা আহলে বাইত কারবালায় এসেছিলেন শহীদদের প্রতি ক্রন্দন করতে, শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের কবর যেয়ারত করতে। কারণ যখন তাদেরকে বন্দী করা হয়েছিল, তখন তাদের ভাই, বাবা, ভাতিজা ও স্বামীর লাশ বে কাফন অবস্থায় পড়েছিল। শহীদদের জন্য ক্রন্দন করলেই তাদেরকে আঘাত করা হত। অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়া হত। আর তাই যখন তারা কারবালায় উপস্থিত হয়েছিল তখন সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

কারবালার ঐ ৭২ শহীদের শাহাদাতবার্ষিকীর ৪০ তম দিবস উপলক্ষে এ পদযাত্রা। যার ইতিহাস বহু পুরোনো। কারো কারো মতে এর ইতিহাস ইমামদের যুগেই প্রত্যাবর্তন করে।

প্রতি বছর, হুসাইনপ্রেমীরা তাদের প্রাণপ্রিয় এ ইমাম এবং তার সাথীদের প্রতি শোক প্রকাশ করতে, ইরাকেরবিভিন্নশহরওগ্রামেনির্দিষ্টপয়েন্টথেকেকারবালারউদ্দেশ্যেপায়েহেটেযাত্রাকরেথাকে। এদেরঅনেকেইরাকেরবসরাশহরথেকেঅর্থাৎপ্রায়৪৫০কিলোমিটারপথপায়েহেটেকারবালায়পৌঁছান। তবেসবচেয়েবেশীলোকসমাগমযেরুটটিতেঘটেসেটাহলনাজাফ-কারবালারুটে ৮০ কিলোমিটার পথে। নাজাফে আমিরুল মু’মিনীন ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এর মাজার থেকে শুরু করে কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.) এর মাজারে এসে যে পদযাত্রা শেষ হয়।

পদযাত্রাটি বিশ্বব্যাপী আহলে বাইত (আ.) এর ভক্তদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও,বেশিরভাগ পশ্চিমা মিডিয়া রহস্যজনকভাবে হয় এটাকে প্রচার করা থেকে বিরত থাকে অথবা এ বিষয়ে অতি ক্ষুদ্র আকারে দায়সারা রিপোর্ট প্রচার করে। অথচ এটি কোন রাজনৈতিক পদযাত্রা নয়, বরং জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্যাতিতদের প্রতি সমর্থনের পদযাত্রা। যার শিক্ষা স্বয়ং ইমাম হুসাইন (আ.) দিয়েছিলেন।

চলতি বছর আরবাঈনের পদযাত্রা বিষয়ে একটি পরিসংখ্যান ইরানের প্রেসটিভি প্রকাশ করেছে যার মূল অংশগুলো আপনাদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হচ্ছে।

চলতি বছর ৪ থেকে ১৯ অক্টোবরের মধ্যে আরবাইন পদযাত্রায় প্রায় ২ কোটি যেয়ারতকারী কারাবায় উপস্থিত হয়েছেন। এই সংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ ছিলেন ইরাকি; যাদেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ।

শুধুমাত্র আরবাঈনের দিন শনিবার, দেড় কোটির বেশী লোক ইরাকের ঐতিহাসিক কারবালা শহরে সমবেত হয়েছিল।

সামগ্রিকভাবে, ৭০ টিরও বেশি দেশের মানুষ চলতি বছর আরবাইনের পদযাত্রা ও অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে। অনুষ্ঠানে অংশ নিতে প্রতিবেশী ইরাকের সাথে প্রায় ৩৫ লাখ ইরানিও উপস্থিত হয়েছিল।

পাকিস্তান থেকে আগত যায়েরদের সংখ্যা ছিল ছিল পাঁচ লক্ষ; সংখ্যার দিক থেকে যা ছিল ইরাক এবং ইরানের পর তৃতীয় স্থানে। এছাড়া ভারত, আজারবাইজান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, লেবানন, কুয়েত, বাহরাইন এবং সৌদি আরবের লোকেরাও বিপুল সংখ্যায় অংশ নিয়েছিলেন ঐতিহাসিক এ অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কলোম্বিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন, ডেনমার্ক, ম্যাসেডোনিয়া, লেবানন, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ওমান, সিরিয়া, আজারবাইজান, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে জায়েররা চলতি বছরের পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন।

এ বছরের আরবাঈনের পদযাত্রা ছিল অনন্য; কারণ ইরাকের বিভিন্ন শহর এবং গ্রামের ৫০০টি পৃথক সূচনা পয়েন্ট থেকে যায়েররা পদযাত্রা শুরু করে, বিশ্বের অন্য কোনও সমাবেশ থেকে যা ভিন্ন।

প্রতিবছরের ন্যায় চলতি বছরও আরবাঈনের পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী এবং ইমাম হুসাইন (আ.) এরযায়েরদের জন্য খাবার ওপানি এবং বিতরণচিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১০ লক্ষেরও বেশি মওকিব তথা স্থায়ী ও অস্থায়ী ফ্রি ডিস্ট্রিবিশন সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া ছিল পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদেরবিশ্রাম ও রাত্রি যাপনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, তাদের ব্যবহারের জন্য শৌচাগার, গোসলখানা এবং নামাযের স্থান।

বিতরণকৃত খাবারের তালিকার মধ্যে ছিল, সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার। এছাড়া ২৪ ঘন্টা ব্যাপী পানি, শরবত, চা, কফি এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ফল, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি।

এছাড়া জায়েরদের সুবিধার্থে বিনামূল্যে ইন্টারন্যাশনাল ফোনকল, জুতা, ব্যাগ ও ট্রলি মেরামত, কাপড় সেলাই, এ্যানাউন্সমেন্ট, ওয়াইফাই সুবিধাসহ আরো  অন্যান্য সেবা প্রদানের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল বিভিন্ন স্থানে ফ্রি স্টল।

এ সকল ফ্রি ডিস্ট্রিবিউশন স্টল ও মওকেবগুলোর বিরাট একটি অংশছিল নাজাফ-কারবালা রুটে। এ রুটের ৮০ কিলোমিটার জুড়ে রাস্তার দু’ধার দিয়ে স্থাপিত এ সকল মওকেব থেকে বিনামূল্যে বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়েছে যায়েরদেরকে।

সামগ্রিকভাবে, হুসাইন প্রেমিরা এই বছরের পদযাত্রায় 500 মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অনুদান দিয়েছে, এর মধ্যে 100 মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ তহবিল ইরাকের পবিত্র নাজাফ শহরের লোকেরা প্রদান করেছে। অনুদানের পরিমাণ আড়াইশো ইরাকি দিনার তথা ২০ সেন্ট থেকে ৬ কোটি ৫০ লাখ ইরাকি দিনার অর্থাৎ $500,000 পর্যন্ত ছিল।#