আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): লেবাননের হিজবুল্লাহ বাহিনী প্রধান গতকাল (শুক্রবার, ১৩ মে) প্রদত্ত এক ভাষণে মধ্যপ্রাচ্য ও লেবাননের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন।
আল-বুকা’ অঞ্চলের জনগণের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে নাসরুল্লাহ আলজাজিরা’র ফিলিস্তিনী সাংবাদিক ‘শিরিন আবু আকলেহ’র শাহাদাতের কথা উল্লেখ করে বলেন: তিনি বহু বছর ধরে ফিলিস্তিনী জনগণের অসহায়ত্ব ও মাজলুমিয়্যাত এবং শত্রু জায়নবাদী ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞের সাক্ষী।
লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রধান বলেন: ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে জায়নবাদী সরকার লেবানন, ফিলিস্তিন ও মিসরের বিভিন্ন এলাকাতে নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছে, যা থেকে তাদের হিংস্রতা প্রমাণিত।
‘ইসরাইলের অস্তিত্ব একটি স্বাভাবিক বিষয়’ এবং ‘তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব’ বলে যে সকল সমঝোতাকারী বিভিন্ন জাতিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে তাদের লজ্জা করা উচিত।
শিরিন আবু আকলেহ’র খ্রিষ্টান হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার শাহাদাতের বার্তাগুলো ছিল এমন; জায়নবাদী শত্রুরা খ্রিষ্টান ও মুসলমান উভয়কেই হত্যা করে, তাদের পবিত্র নিদর্শনসমূহকে ধ্বংস করে এবং তাদের বসত-ভিটা ধ্বংস করে দেয় -এতকিছু ঘটছে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত জায়নবাদী সরকারের অমানবিক ও বর্ণবাদী পদক্ষেপের কারণেই। সমঝোতাকারীরা যা-ই করুক না কেন জায়নবাদীদের আচরণে কখনই পরিবর্তন আসবে না।
সিরিয় সৈন্যবাহী একটি বাসে সন্ত্রাসীদের রকেট হামলার কথা উল্লেখ করে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ নাবল ও আল-যাহরা’র শহীদদের পরিবার -যারা স্থানীয় এলাকা প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল- এবং উত্তর আলেপ্পোর ১০ শহীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
তিনি বলেন, ফ্রন্ট লাইনে উপস্থিতি এবং প্রতিরোধ আন্দোলনকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে আল-বুকা’ ও এ অঞ্চলের জনগণের ভূমিকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভি ও উম্মু ইয়াসির আল-মুসাভি দক্ষিণ লেবাননের আল-বুকা’ অঞ্চলেই শহীদ হয়েছেন।
আমাদের প্রতিরোধ, আল-বুকা’ অঞ্চলের টিলাগুলো থেকে, সমতল ভূমি, বসত-বাড়ী, জনগণের অন্তর এবং তাদের দূরদৃষ্টি থেকে শুরু হয়েছে। পশ্চিম আল-বুকা’ পর্যন্ত পরিচালিত অভিযান এই আল-বুকা’ থেকে শুরু হয়েছিল; যা সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভি’র মত সেনাপতি শহীদ হওয়ার পরও থামেনি।
যদি সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর পরিকল্পনা সিরিয়াতে সফল হয় নিঃসন্দেহে তা আল-বুকা’ ও লেবাননের জনগণের জন্য বিরাট এক হুমকি হয়ে দেখা দেবে। রাজনৈতিক এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লেবানন সেনাবাহিনী আল-জারুদ এলাকায় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে নিষিদ্ধ হয়েছে।
আল-জারুদের যুদ্ধের ঘটনায় একটি বিশেষ দল লেবানন সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত রেখেছিল। যে সরকারেই তাদের সংখ্যাগরিষ্টতা থাকবে তারা লেবানন সেনাবাহিনীকে দেশের প্রতি যেকোন কোনপ্রকার সীমালঙ্ঘনের জবাব প্রদানের অনুমতি দেবে না। এরাই ধারাবাহিক প্রেস কনফারেন্স করেছিল, আপনারা কি ভুলে গেছেন?
আজ যদি বালাবাক-এ (প্রতিরোধ আন্দোলনের) অস্ত্র -যে প্রতিরোধ আন্দোলনকে মুছে ফেলতে তারা সদা সচেষ্ট- ও (সামরিক) সক্ষমতা না থাকত তাহলে আজ যোহলাহ, পশ্চিম বুকা’, রশিয়া ও সমগ্র লেবাননের জনগণ কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হত?
আল-বুকা’র জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন: যারা বুকা’ রক্ষার্থে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে এবং যারা আপনাদের বাড়ী-ঘরে হামলার জন্য প্রস্তুত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ নিয়েছে -এ দু’দলের বিষয়ে দৃঢ়চিত্তে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
বুকা’র জনগণ! যারা আপনাদের বিরুদ্ধে এবং প্রতিরোধ আন্দোলন ও তাদের সামরিক সক্ষমতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তাদের বিপক্ষে আপনাদের জবাব কি হবে?
নিজেদের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করুন, যে সকল খ্রিষ্টান দলগুলো সশস্ত্র গ্রুপগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের সাথে সংঘাতে জড়াতে লেবানন সেনাবাহিনীকে নিষিদ্ধ করেছে, তারা কি আপনাদের বিষয়ে কিছু ভেবেছিল? তারা কি আপনাদের রক্ত, সম্পত্তি ও বাসগৃহের কথা ভেবেছিল? আমি আপনাদেরকে বলছি, এ সকল বিষয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই।
লেবাননের বিদ্যুৎ খাত সংস্কারে বাধাদানকারী দেশটি হল আমেরিকা। তারা লেবাননে বিনিয়োগ থেকে সারা বিশ্বকে বিরত রেখেছে এবং আপনাদের দেশে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুকদের বিনিয়োগ থেকে আপনাদেরকে বঞ্চিত করেছে। এই আমেরিকাই লেবানিজদের অর্থ চুরি করেছে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে আপনাদেরকে দূর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পক্ষান্তরে প্রতিরোধ আন্দোলনের সামরিক সক্ষমতা না বিদ্যুৎ খাত সংস্কার ও বাধ নির্মাণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর না বিগত দশকগুলোতে লেবাননের অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অথচ ওয়াশিংটন লেবাননিজদের ডিপোজিটগুলো বিদেশে ট্রান্সফারে সহযোগিতা করেছে।
লেবাননে বিনিয়োগে বাধা দিয়েছে আমেরিকা এবং চুরির ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দিয়েছে তারা। যে কেউ মার্কিন দূতাবাসে নির্বাচনের তালিকা তৈরি করেছে তাদের উচিত ওয়াশিংটনকে বলা যেন লেবাননিজদের ডিপোজিটগুলোকে লেবাননে ফিরিয়ে দেয়।
আমাদের কাছে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হলে আমরা নিজেদের দলীয় স্বার্থে মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করি না বরং এর উন্নয়নে নিজেদের সম্পদ থেকেও ব্যয় করি।
তিনি বলেন: লেবাননের জনগণ বর্তমানে যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি তা নিরসনে বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে ন্যায়নিষ্ঠ এবং সক্ষম কোন সরকারের ক্ষমতায় আসা উচিত। যে সকল এলাকাতে আমরা উপস্থিত ছিলাম এবং আছি সেসকল এলাকার ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা আমাদের কাছে বিদ্যমান সবকিছু কাজে লাগিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও কাজে লাগাবো, তবে আমাদেরকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ্ তার বক্তব্যের অপর অংশে লেবাননের জনগণের জন্য রেলপথ নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন: আমরা একটি কৌশলগত ট্যানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি আপনাদেরকে প্রদান করছি যা আল-বুকা’কে রাজধানী বৈরুতের সাথে সংযুক্ত করবে।
তার সংযোজন: লেবানন-সিরীয় সুসম্পর্ক শীর্ষে ফিরে আসাটা অতীব জরুরী। এর সুফল উভয় দেশই ভোগ করবে, বিশেষ করে বুকা’ অঞ্চলের জনগণ।
অনুষ্ঠিত নির্বাচনী প্রচারণায় হাস্যকর বিভিন্ন কথা আমরা শুনেছি যা কারো কারো নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির অবক্ষয়েরই প্রমাণ; এরা নিজেদেরকে লেবাননের জনগণের ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং জনগণের সমস্যার সকল সমাধান জানে বলে দাবী করে! নিশ্চিত ভাবে তাদের একজন ১১ বিলিয়ন ডলার নিখোঁজ হওয়া এবং অর্থনৈতিক খাতে ভুল নীতির জন্য দায়ী; যার কারণে লেবাননে আজ এ বিপর্যয়ের মুখোমুখি, (মজার বিষয়) এ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে তাদের (একমাত্র) সমাধান হল হিজবুল্লাহকে সকল ক্ষেত্রে কোনঠাসা করা!!!
তিনি বলেন: তাদের একজন চায় ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শিয়াদের হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে। ওহে! (তোমাকে বলছি) যার শেঁকড়ের কোন ঠিক নেই, তুমি চাও ইমাম হুসাইন (আ.)-কে আমাদের অন্তর থেকে কেড়ে নিতে?!
আরেকজন চায় মুসলিম নারীদেরকে হিজাব থেকে পরিত্রাণ দিতে এবং লেবাননের জনগণকে হিজাবমুক্ত করতে!
বর্তমানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা এ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, শহীদ আওয়াল, শহীদ সানী, হাসান কামেল আস-সাবাহ ও জুবরান খালিল জুবরান সম্পর্কে কথা বলার পরিবর্তে তারা বলে যে, লেবাননিজদের স্বকীয়তা হচ্ছে নাচ এবং সাঁতার। এসব কথার মাধ্যমে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে এবং তাদেরকে বোকা বানাচ্ছে।
তিনি তার বক্তব্যের শেষাংশে বলেন: লেবাননে আশ্চর্যজনকভাবে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। নির্বাচনের দিন ভোট প্রদান করে প্রতিরোধ আন্দোলন ও লেবাননের ভবিষ্যত ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত তাদের উদ্দেশ্যে বার্তা ছুঁড়ে দেয়ার এক মোক্ষম সুযোগ।
তিনি বলেন: কেউ কেউ ৫ লক্ষ ডলার ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনে হিজবুল্লাহ’র প্রার্থীদের তালিকা দূর্বল করার (ব্যর্থ) চেষ্টা চালাচ্ছে।#176