'সরদার হুর' নামে পরিচিত শহীদ আলী হাশেমি ছিলেন ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন সাহসী এবং বিখ্যাত সেনাপতি। যুদ্ধের কলা কৌশল সম্পর্কে তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং সাদ্দামের বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরানের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাসে খাইবার ও বদরের মহান অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এই সাহসী সেনাপতি জনগণ এবং তার সহযোদ্ধাদের হৃদয়ে এতটাই গেঁথে যান যে সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনেয়ী তাকে "খুজেস্তানের তরুণ আরব সেনাপতি" হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি আগ্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং যার নাম এই ভূমি ও অঞ্চলের ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। এই প্রবন্ধে আমরা এই মহান শহীদের আবেগঘন এবং মহাকাব্যিক জীবনের দিকে নজর দেব।
কমান্ডার আলী হাশেমি
জন্ম: ঈমান ও ত্যাগের আলোকে জীবনের সূচনা
আলী হাশেমী ১৩৪০ হিজরীতে দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের আহবাজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এমন একটি পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন যারা দরিদ্র হলেও আল্লাহ এবং আহলে বাইত (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল। তার শৈশবকাল থেকেই মসজিদ কেবল তার জন্য একটি স্থান ছিল না; এটি ছিল একটি পবিত্র স্থান যার সাথে তিনি তার সমগ্র সত্তাকে আবদ্ধ করেছিলেন। তার মা গর্বের সাথে বর্ণনা করেন, 'আলী গভীর রাত পর্যন্ত মসজিদে থাকতেন, অবর্ণনীয় ভালোবাসা দিয়ে তা ঝাড়ু দিতেন এবং পরিষ্কার করতেন।" কুরআনের প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই ছিল যে তার বাড়ির দরজায় একটি চিহ্ন লেখা ছিল: "শুধুমাত্র একটি সালাওয়াতের বিনিময়ে বিনামূল্যে কুরআন শিক্ষা!"
শহীদ হাশেমির কিশোর বয়স - বাম দিক থেকে দ্বিতীয়
সংগ্রামের সময়কাল: বিপ্লব থেকে রক্ষী বাহিনী গঠন পর্যন্ত
ইসলামী বিপ্লবের টালমাটাল দিনগুলোতে তরুণ আলী হাশেমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন। তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে বহুবার গ্রেপ্তার এবং কারারুদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই তিনি আরও শক্তিশালী মনোবল নিয়ে ফিরে আসেন। বিপ্লবের বিজয়ের পর তিনি ইসলামী বিপ্লবী কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বিপ্লবী গার্ড বাহিনী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই পবিত্র প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি এবং তার সঙ্গীরা আজাদেগান সমভূমির বিপ্লবী যুবকদের সংগঠিত করেন এবং হামিদিয়াহ বিপ্লবী গার্ড বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।
বিবাহ: একটি সংক্ষিপ্ত জীবন, কিন্তু ভালোবাসায় পরিপূর্ণ
শহীদ হাশেমি ১৯৮৪ সালে একটি পবিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই মিলনের ফল ছিল দুটি সন্তান, জয়নব এবং মোহাম্মদ হুসেন। কিন্তু ভাগ্য লিখে রেখেছিল যে তিনি আর তার পরিবারের অতিথি থাকবেন না এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যাবেন।
কমান্ডার সোলেইমানির সঙ্গে কমান্ডার আলী হাশেমি
একাডেমিক কার্যকলাপ: প্রতিরক্ষা বেছে নেওয়া একজন মেডিকেল ছাত্র
আলী হাশেমি কেবল একজন যোদ্ধা ছিলেন না তার ছিল গতিশীল এবং বৈজ্ঞানিক মন। বিপ্লবী সংগ্রামের সাথে সাথেই তাকে মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল এবং এমনকি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৃত্তির জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু যখন ইরানের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছিল,তখন তিনি তৎক্ষণাৎ সমস্ত ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে একপাশে রেখে বলেছিলেন, যুদ্ধ ফ্রন্ট আমার অগ্রাধিকার।"
চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে উপস্থিতি: শত্রুর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বাধা
সাদ্দামের ইরাকি বাথ শাসনের কাপুরুষোচিত আক্রমণের সাথে সাথে হাশেমি সবচেয়ে কঠিন ফ্রন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন,যথা দক্ষিণ অক্ষ। তিনি তার কৌশল এবং সাহস দিয়ে ইরাকি বাহিনীর অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং হামিদিয়াহ এবং আহবাজের পতন রোধ করেছিলেন। এমনকি তিনি "কারখেহ কোর" নাম পরিবর্তন করে "কারখেহ নূর" রাখেন, কারণ যোদ্ধাদের উপস্থিতির সাথে সাথে যুদ্ধের অন্ধকার আশার আলোয় পরিণত হয়েছিল।
ইরাকি বাথ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্মুখ সারিতে শহীদ হাশেমি
নুসরাত ঘাঁটি গঠন: এক অতুলনীয় মহাকাব্যের সূচনা
যুদ্ধের তৃতীয় বছরে, শহীদ হাশেমির তত্ত্বাবধানে নুসরাত ঘাঁটি গঠিত হয়েছিল। এই ঘাঁটি জটিল গোয়েন্দা ও অভিযান পরিচালনা করত। তিনি স্থানীয় বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম উভচর অভিযানের নকশা করেছিলেন। খাইবার এবং বদর অভিযানে নুসরাত ঘাঁটি এত উজ্জ্বলভাবে আলোকিত হয়েছিল যে, এমনকি ইরাকি মাটির গভীরে ছদ্মবেশে থাকা সিনিয়র আইআরজিসি কমান্ডারদের যুদ্ধ পরিকল্পনাগুলো তিনি ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করেছিলেন। আরও আশ্চর্যজনকভাবে, এই ঘাঁটির ৪২০টি গোয়েন্দা অভিযান সামান্যতম ফাঁস ছাড়াই পরিচালিত হয়েছিল!
শহীদ: অনন্তকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা
১৯৮৮ সালের ২৮ জুলাই, মাজনুন দ্বীপে বাথিস্ট বাহিনীর বিশাল আক্রমণের পর শহীদ হাশেমি সদর দপ্তর ছেড়ে যাওয়ার সময় শত্রু হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে আক্রান্ত হন এবং ২৬ বছর বয়সে শাহাদাতের মহান মর্যাদা অর্জন করেন। সেই সময় ষষ্ঠ ব্রিগেডের প্রধান আলী আসগর গোরজিজাদেহ আহত এবং বন্দী হওয়ার কারণে ধারণা করা হয়েছিল যে হাশেমিও বন্দী ছিলেন। কিন্তু ২২ বছর অপেক্ষার পর ২০১০ সালে ষষ্ঠ ডিবিশনের সদর দপ্তরের কাছে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং জনগণের ব্যাপক শ্রদ্ধায় এবং ভালবাসায় আহবাজে সমাহিত করা হয়।শহীদ আলী হাশেমি কেবল একজন সেনাপতিই নন বরং স্বদেশের প্রতি প্রতিরোধ, বিশ্বাস এবং ভালোবাসার প্রতীকও। #
Your Comment