উঁচু দেয়ালে ঘেরা ফ্রান্সের এই কারাগারে মাদক পাচারকারী এবং বিপজ্জনক অপরাধীদের আটক রাখা হয়, সেখানে ৩৮ বছর বয়সী ইরানি নারী অনুবাদক এবং লিওন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্রীকে বন্দী রাখা হয়েছে। মাহদি এসফান্দিয়ারি একজন ইরানি মহিলা যার একমাত্র অপরাধ ছিল অনলাইনে গাজার শিশুদের সমর্থন করা। এখন তিনি নাগরিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা দাবিদার ফ্রান্সের রোষানলে পড়েছেন। পার্সটুডে-র এই নিবন্ধে এবার এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো:
গুম হয়ে যাওয়া
গত বছর ফার্সি ১৪০৩ সালে ১২তম মাসের প্রথম দিক থেকে, ইরানে এসফান্দিয়ারির পরিবার ফ্রান্সে তাদের মেয়ের খোঁজ পাচ্ছিল না। ফরাসি পুলিশের কয়েক মাস নীরবতা এবং ইরানি কর্তৃপক্ষের তদারকির পর, জানা যায় যে ইহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক গাজার জনগণের গণহত্যার নিন্দা করার জন্য তাকে আটক করা হয়েছিল। এসফান্দিয়ারিকে ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই কারাগারে প্রায় ৯০ দিন ধরে তীব্র মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নির্জন কারাগারে রাখা হয়।
প্যারিসের সরকারি কৌসুলি কী বলছেন?
২০২৩ সালের অক্টোবরে, এসফান্দিয়ারি একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে ফিলিস্তিনের অসহায় ও নিপীড়িত জনগণের সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছিলেন, কিন্তু প্যারিসের সরকারি কৌসুলি দাবি করেন যে তিনি নাকি তার ওই লেখায় ইহুদি-বিদ্বেষ প্রচার করেছিলেন। অথচ তার পরিবার এবং বন্ধুরা বলেছেন যে মাহদিহ কেবল মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছে। এ অবস্থায় গাজার নিরীহ মানুষের সমর্থনে কথা বলা কীভাবে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়? এবং কিভাবেই বা গাজায় ইসরাইলি বোমা হামলার প্রতি ফ্রান্সের সমর্থনকে বাক স্বাধীনতা বলে দেখা হচ্ছে? ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়ের।
ফ্রেসনেস কারাগার
প্যারিসের ফ্রেসনেস কারাগারে ১,৮০০টি নির্জন সেল রয়েছে। সর্বোচ্চ ২,১৮০ জন বন্দীর জন্য তৈরি, ১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে এটি উদ্বোধনের সময় এটি বিশ্বের বৃহত্তম কারাগার ছিল। ফ্রান্সের বেশিরভাগ আটক কেন্দ্রের মতো, এই কারাগারটিতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অতিরিক্ত বন্দী আটক রয়েছে। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারী ইউরোপীয় মানবাধিকার বিষয়ক আদালতও ফ্রেসনেস কারাগারে অতিরিক্ত বন্দী রাখার জন্য ফ্রান্সের নিন্দা জানিয়েছিল।
ফ্রেসনেস কারাগার
এই কারাগারে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ভয়ঙ্কর অপরাধীদের রাখা হয়, যারা বৃহৎ গ্যাং, খুনি, বিপজ্জনক অপরাধী, সশস্ত্র ডাকাত এবং সংগঠিত অপরাধের সাথে জড়িত।
মাহদি এসফান্দিয়ারির বোন জাহরা এসফান্দিয়ারি
মাহদির বোন মিসেস "জাহরা এসফান্দিয়ারি" বলেন: প্রায় ৭০ দিন পর তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ হলে তার বোন ফ্রেসনেস কারাগারের শোচনীয় এবং কঠিন পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে এই পরিস্থিতির সমালোচনা করেন।
মাহদি এসফান্দিয়ারি
এই ইরানি নারীর গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় X সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ইরানি ব্যবহারকারীরাও হ্যাশট্যাগ দিয়ে মাহদি এসফান্দিয়ারিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ফাতেমা মোহাম্মদ বেইগি নামে একজন ইরানি এক্স ব্যবহারকারী ফরাসি সরকারের এই আচরণকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসাবে অভিহিত করে এটাকে মানবাধিকারের দাবিদার দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতির দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন: শুধুমাত্র গাজার জনগণের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে ফ্রান্সের কুখ্যাত এই কারাগারে ৮০ দিন জেলে কাটাতে হয়েছে! এটা অবিশ্বাস্য। এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মানবাধিকারের দাবিদার দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতির দৃষ্টান্ত।
একই প্রসঙ্গে, X নেটওয়ার্কের আরেক ইরানি ব্যবহারকারী "Seydhani Hashemi" লিখেছেন: ফ্রান্স ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করার অজুহাতে মাহদিহ এসফান্দিয়ারি নামে একজন ইরানি নারীকে গ্রেপ্তার করেছে, যিনি ৮ বছর ধরে লিওনে বসবাস করে আসছেন! মত প্রকাশের স্বাধীনতার উৎস হিসেবে দাবি করা একটি দেশের এমন আচরণ হাস্যকর।
ইউরোপে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনকারী ১০০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তার
মানবাধিকার সংস্থাগুলির পরিসংখ্যান দেখায় যে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইউরোপে ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইউরোপীয় সরকারগুলোর এই পদক্ষেপে প্রশ্ন উঠেছে যে, ইউরোপে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি কেবল পশ্চিমা নীতির সাথে যারা একমত তাদের জন্য? যদি এসফান্দিয়ারি ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করার পরিবর্তে ইসরাইলি অপরাধকে সমর্থন করতেন, তাহলে কি তাকে গ্রেপ্তার করা হত? গাজা সম্পর্কে লেখার জন্য ফ্রান্স যখন একজন অনুবাদককে কারারুদ্ধ করে, তখন মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবির এই দেশটির কী কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে?
পশ্চিমা নীরবতার সমালোচনা
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকাই এই বিষয়ে বলেছেন: আমরা এখনও ফ্রান্সের কাছ থেকে স্পষ্ট উত্তর পাইনি। নিপীড়িতদের সমর্থন করা কেন অপরাধ?
Your Comment