৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ২৩:০৫
সারা দেশে বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার

বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগারের ধারণাটি মূলত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের মাথা থেকে এসেছে।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): আজকের বাংলাদেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে পাঠাগারের সংখ্যা যেমন কম, তেমনি পাঠক তৈরির প্রয়াসও দুর্লভ। এমনই এক কঠিন সময়ে বসুন্ধরা শুভসংঘ তৈরি করেছে ভিন্ন এক ধারা।



একটি নীরব সামাজিক বিপ্লব হিসেবে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চালু করা হচ্ছে বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নীলফামারীর সৈয়দপুরে ‘মননবাড়ি বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার’ উদ্বোধন করা হয়েছে।

১
সম্প্রতি নীলফামারীর সৈয়দপুরে মননবাড়ি বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার উদ্বোধন করা হয়েছে। 

গত ২২ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে উপজেলার এক নম্বর কামারপুকুর ইউনিয়নের কিসামত কামারপুকুর সরকারপাড়ায় এই পাঠাগারটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

ছোটদের জন্য গল্পের বই, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্য ও সহপাঠ্য বই আর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আত্মোন্নয়ন, ধর্ম, ইতিহাস ও সাহিত্যের অসাধারণ সংগ্রহ রয়েছে এখানে। এই পাঠাগারে বই পড়তে কারো টাকার দরকার নেই, চাই শুধু আগ্রহ ও সময়।

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় পাঠাগারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন সৈয়দপুর সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল কালাম আজাদ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) সৈয়দপুর উপজেলা প্রকৌশলী এম এম আলী রেজা রাজু, হাজারীহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. লুৎফর রহমান চৌধুরী, সৈয়দপুর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান হাবিব প্রমুখ।

বসুন্ধরা শুভসংঘ সৈয়দপুর উপজেলা শাখার সভাপতি ও সৈয়দপুর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের সিনিয়র শিক্ষক আলহাজ মো. নাছিম রেজা শাহ্র সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক ও শিশু স্বর্গ বিদ্যা নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মো. শফিকুল আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বসুন্ধরা শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান।

অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল খালেক ফারুক, কামারপুকুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. জাহেদুল ইসলাম প্রমুখ। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আশপাশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর পদচারণে মুখরিত ছিল পুরো পাঠাগার প্রাঙ্গণ। সকাল থেকেই অনেকে এসে বই ঘেঁটেছে, পড়েছে।

নিয়মিত চারটি পত্রিকা রাখা হবে এই পাঠাগারে, এমনটি জানালেন আয়োজকরা। শুক্রবার হওয়ায় পাঠাগারের পাশের মসজিদে জুমার নামাজ শেষে দোয়ার আয়োজন করা হয়েছিল।

দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা বসুন্ধরা গ্রুপের মানবিক কাজের ধারাবাহিকতার জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। নামাজ শেষে মুসল্লিরা পাঠাগার ঘুরে দেখেন। অনেকে বসে বই পত্রিকা পড়েন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, সবাই মিলে যদি একটি গ্রামীণ পাঠচর্চা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি, তবে শুধু নেতৃত্বের নয়, চিন্তা, মনন ও নৈতিকতার বাতিঘর হয়ে উঠবে এই পাঠাগার। আমাদের প্রজন্মকে বইয়ের সঙ্গে ভালোবাসা শেখাবে, আত্ম-আবিষ্কারে সাহায্য করবে এবং একটি মানবিক ও আলোকিত সমাজ গড়ে তুলবে।

আমরা স্বপ্ন দেখি, একদিন এই পাঠাগার হবে স্কুল শিক্ষার্থীদের পাঠচর্চার আশ্রয়, তরুণদের আত্মনির্মাণের স্থান এবং প্রবীণদের স্মৃতিচারণার নিরিবিলি উঠান, যেখানে থাকবে সাহিত্যসন্ধ্যা, গবেষণা পাঠ, স্বেচ্ছাসেবী প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিভিত্তিক ডিজিটাল লার্নিং ব্যবস্থা।

বসুন্ধরা শুভসংঘের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম বলেন, ‘এই পাঠাগারটি আমার চোখে কেবল একটি পাঠাগার নয়, এটি একটি মূল্যবোধের কেন্দ্র, একটি সমাজ পরিবর্তনের সূত্র; যেখানে পাঠে শুরু হয় পরিচয়, চিন্তায় জন্ম নেয় নেতৃত্ব, আর আলাপে গড়ে ওঠে মানবিক সম্পর্ক। আমি বিশ্বাস করি, এই পাঠাগার আগামী দিনে বাংলাদেশের শত শত তরুণের চিন্তাকে প্রসারিত করবে।’

আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মানুষের জীবন ও চরিত্র গঠনে এবং স্বপ্নপূরণে বই পড়া প্রয়োজন। বই ও পাঠাগার জ্ঞান অর্জনের একমাত্র মাধ্যম। স্বপ্নপূরণে শুধু ক্লাসের পাঠ্যবই নয়, সৃজনশীল ও মনীষীদের জীবনী নিয়ে লেখা ভালো বইগুলো মনোযোগসহকারে পড়তে হবে।

উচ্চশিক্ষিত ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে অবশ্যই শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক পড়তে হবে, তবে জ্ঞান অর্জন তথা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে ক্লাসের বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বই নিয়মিত পড়া উচিত।’

লুৎফর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এই পাঠাগারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত পল্লীর শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। শুধু পাঠাগার করলেই হবে না, পাঠক ধরে রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে পাঠাগার ধরে রাখা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ।

আর এখন আমরা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আসক্ত। তার পরও এই পাঠাগার আমাদের শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বই ও পত্রপত্রিকা পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে বলে আমি বড় আশাবাদী।’

সৈয়দপুর উপজেলা প্রকৌশলী এম এম আলী রেজা রাজু বলেন, ‘এই পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে এলাকার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এখন থেকে তারা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বইও পড়ার সুযোগ পাবে।

তারা যেমন এখানে বসে বই পড়বে, তেমনি এখান থেকে বই নিয়ে গিয়ে অবসরে বাড়িতে বসেও পড়তে পারবে। এলাকার সাধারণ মানুষ পাঠাগারে থাকা দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়ে দেশ-বিদেশের দৈনন্দিন খবরগুলো জানার সুযোগ পাবে।

বসুন্ধরা শুভসংঘের এমন অসাধারণ একটি উদ্যোগের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি রইল আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।’

আব্দুল খালেক ফারুক বলেন, ‘বসুন্ধরা পাঠাগারের ধারণাটি মূলত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের মাথা থেকে এসেছে। তারই প্রচেষ্টা ও আগ্রহে এবং সার্বিক দিকনির্দেশনায় সারা দেশে বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার স্থাপন করা হচ্ছে।

এটি একটি শুভ উদ্যোগ। আমি নিজেও ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমার এলাকায় একটি পাঠাগার পরিচালনা করছি। পাঠাগার ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আর বর্তমান সময়ে পাঠক ধরে রাখা আরো দুরূহ ব্যাপার।

তাই নিয়মিত তদারকিতে রাখতে হবে। পাঠকরা কোন কোন বই পছন্দ করেন, সেসব সংগ্রহে রাখতে হবে। পাঠক ধরে রাখতে প্রতি মাসে বইয়ের ওপর বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে পাঠকসংখ্যা যেমন বাড়বে, আমাদের সমাজও আলোকিত হবে।’

২
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার চরখিরাটি গ্রামের বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগারটি পাঠকপূর্ণ থাকে সব সময়

নীরবতায় ঢেকে থাকা গ্রামীণ জনপদে হঠাৎ করেই যেন আলোর ঝলকানি চোখে পড়ে। সেই আলোটি আসছে বসুন্ধরা শুভসংঘের পাঠাগার থেকে। একদিন গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার ঘাগটিয়া ইউনিয়নের চরখিরাটি দিয়ে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলাম। চোখে পড়ে যায় ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার’।

৩
অবসর সময়ে পাঠাগারে বই পড়ে সময় কাটান শিক্ষার্থীরা

জ্ঞানের আলোতে আলোকিত সমাজ গড়তে পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজে গড়ে উঠেছে বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার। ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৩টা বাজলেই বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগারে ভিড় জমে শিক্ষার্থীদের। বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকে পাঠকরা। দিন দিন পাঠাগারে বাড়ছে পাঠকসংখ্যা, অন্যদিকে বাড়ছে বইয়ের চাহিদাও।

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha