২৩ আগস্ট ২০২৫ - ১৩:৩৪
হামাস সদস্যদের মৃত্যু নিয়ে ভয়ংকর মিথ্যাচার, চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস

গাজায় নতুন হামলার প্রস্তুতির মাঝে একটি গোপনীয় ডেটাবেস থেকে পাওয়া তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব দেশ ও বিশ্বকে এমন এক যুদ্ধ সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়েছে, যেখানে বেশিরভাগ হতাহতই ছিল বেসামরিক মানুষ।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): চলতি বছরের মে মাসে ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা ডেটাবেসে হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদি যোদ্ধাদের নাম ছিল ৪৭ হাজার ৬৫৩টি। এর মধ্যে ৮ হাজার ৯০০ জনকে নিহত বা “সম্ভবত নিহত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। 

এই সংখ্যা মোটের এক-পঞ্চমাংশেরও কম এবং রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে দেওয়া ১৭ হাজার থেকে ২০ হাজার হামাস সদস্য নিহতের দাবির চেয়ে অনেক কম।

গোয়েন্দা দল বলছে, ডেটাবেসে হয়তো কিছুটা কম গণনা হয়েছে, কিন্তু গণমাধ্যম ও জনসম্মুখে প্রকাশিত সংখ্যাগুলো ছিল অবৈধ ও অতিরঞ্জিত।

একজন শীর্ষ পশ্চিমা সামরিক সূত্র বলেছে, শত্রু বাহিনীর সদস্যদের হত্যা সবসময় বিজয়ের পূর্বশর্ত নয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অভাবে ইসরায়েলি বাহিনী নিহত হামাস সদস্য সংখ্যাকেই সাফল্যের সূচক বানিয়ে তোলে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর ইসরায়েলের এলিট ইউনিট ৮২০০-এর তৎকালীন প্রধান ইয়োসি সারিয়েল প্রতিদিনের নিহতের সংখ্যা একটি গ্রাফে উপস্থাপন করা শুরু করেন, যেটিকে “যুদ্ধ ড্যাশবোর্ড” বলা হতো।

একটি সূত্র বলেছে, এটা যেন একটা ফুটবল খেলার মতো ছিল। অফিসাররা বসে সংখ্যা বাড়তে দেখতেন ড্যাশবোর্ডে।

সারিয়েল ও অন্যান্য সিনিয়র কমান্ডাররা হামাস যোদ্ধাদের মৃত্যুকে নিজেই এক ধরনের লক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করেন। কিন্তু হামাস ধ্বংস হলে গাজা কে বা কীভাবে শাসন করবে, সে বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। জঙ্গিদের হত্যা করে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কী ধরনের রাজনৈতিক ছাড় আদায় করা যায়, সেটাও বিবেচনায় ছিল না।

সারিয়েলের এক সহকর্মী বলেন, ‘আমাদের ছিল একটা সুন্দর, ইন্টার‌্যাক্টিভ ড্যাশবোর্ড, কিন্তু আমরা যুদ্ধের লক্ষ্যটাই বুঝিনি। সব কিছু সংখ্যায় পরিণত করে ফেলা খুব হতাশাজনক ছিল।’ সারিয়েল এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

বেশ কয়েকটি সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর ৭ অক্টোবর, ২০২৩ সালের ব্যর্থতা ঢাকাতে জনসমক্ষে হামাস নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। এই সংখ্যা ইসরায়েলি মিডিয়াতে নিয়মিত প্রকাশিত ও পুনরাবৃত্তি করা হতো। 

‘কিন্তু উচ্চ হারে বেসামরিক হতাহতের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র ‘হামাস নিহতের সংখ্যা” দিয়ে সফলতা মাপা কৌশলগতভাবে ভুল এবং আত্মঘাতী ছিল’, বলেন এক শীর্ষ পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘তারা ভুল পরিসংখ্যান মেপে চলেছে। আপনি কখনোই হামাসের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে হত্যা করতে পারবেন না। তাহলে বিজয়ের সংজ্ঞা কী?’

প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলে আসছেন, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় গেছে “হামাস ধ্বংস” করতে। একটি এতটাই অস্পষ্ট লক্ষ্য যা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া যায়।

হামাসের যে সামরিক ক্ষমতা ২০২৩ সালে ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ মানুষ হত্যা করেছিল, তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ৭ অক্টোবর হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে প্রায় সবাই নিহত হয়েছেন, তাদের অনেক উত্তরসূরিও।

ইসরায়েল গাজার বেশিরভাগ অঞ্চলকে পরিণত করেছে এক ধ্বংসস্তূপে, প্রাক-যুদ্ধ জনসংখ্যার প্রতি ১০ জনে ১ জনকে হত্যা বা আহত করেছে এবং অবশিষ্ট ক্ষুধার্ত মানুষদের ঠেলে দিয়েছে গাজার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায়।

সেই মহাপ্রলয়সম গাজা প্রেক্ষাপটে যেখানে তীব্র বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে বহু হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে; সেখানেও ইসরায়েলের ডেটাবেসে তালিকাভুক্ত হামাস ও ইসলামিক জিহাদ যোদ্ধাদের বেশিরভাগই এখনো জীবিত।

ইসরায়েল বহু ব্যক্তিকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে এবং লক্ষ্যবস্তু বানায় তারা, যদিও তারা যুদ্ধে অংশ নেন না এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তারা সুরক্ষিত বেসামরিক নাগরিক হিসেবে গণ্য হন।

গোয়েন্দা সূত্রগুলোর মতে, যেসব অপারেটিভদের সেনাবাহিনী নিশ্চিতভাবে হত্যা করেছে বলে বিশ্বাস করে, তাদের প্রতিটির সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য সংযুক্ত থাকে, যা তাদের “জঙ্গি” হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে।

একটি সূত্র জানায়, ‘যেকোনো ব্যক্তির মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের যেভাবেই হোক জানা থাকলে, সেটা ডকুমেন্টে লিপিবদ্ধ করা হয়। সেই তালিকায় ৭ হাজার ৩৩০ জন নিশ্চিতভাবে নিহত এবং ১ হাজার ৫৭০ জনকে “সম্ভবত নিহত” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ৭৫০ জন সিনিয়র হামাস সদস্যের মধ্যে ৩০০ জনকে “নিশ্চিত” বা “সম্ভবত” নিহত বলা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক ডেটাবেসের তথ্যকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিহতের তালিকার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, গাজায় প্রতি ১ জন হামাস সদস্যের বিপরীতে ৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। গণহত্যার অভিযোগে যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়, গণহারে মানুষ হত্যা তার একটি এটা এবং এ কারণেই গবেষক, আইনজীবী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগ এনেছে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha