৯ ডিসেম্বর ২০২৩ - ১৭:৪৩
শিয়া আলেমদের হত্যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিয়াদেরকে হেরাত শহর ত্যাগ করতে বাধ্য করা: ফাইয়াজ উরুযগানী

আফগানিস্তানের এই শিয়া আলেম বলেন, প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে হাজারা ও শিয়াদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা যাতে শিয়ারা এবং আলেমরা তাদের নিজ এলাকা ও বাড়িঘর ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয় তথা বাসভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): শুক্রবার মোটরসাইকেল আরোহী বন্দুকধারীরা, হেরাত প্রদেশের সিজদাহম জেলার শিয়া অধ্যুষিত এলাকায়, “কুরে মিল্লি” এবং “শাহরাকে সাবজ” নামক সড়কে বেশ কয়েকজন শিয়া ও হাজারা পথচারীকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে।

এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলায় ৬ জন শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। শহীদদের মধ্যে মোহাম্মদ মোহসেন হামিদি এবং মোহাম্মদ তাকী সাদেকী নামক দুজন আলেম রয়েছেন।

এই সন্ত্রাসী হামলা এমন এক সময়ে ঘটেছে, যেখানে এই ঘটনার প্রায় আট দিন আগে, এই শাহরাকে জিবরাইলে মোটরসাইকেল আরোহী বন্দুকধারীর হামলায় রজব আলী আখলাকী এবং খাদেম হোসাইন হেদায়াতী নামক পৃথক দুজন শিয়া আলেম মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সময়ে এসেও হেরাত শহরে শিয়া আলেমদের হত্যা ও শহীদ করার মত ঘটনা ঘটছে।

আফগানিস্তানের হেরাত শহরে কতিপয় হাজারা শিয়া মুসলিম ও আলেমদের হত্যার সূত্র ধরে, আফগানিস্তানের শিয়া ওলামা পরিষদের সহকারী হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ ফাইয়াজ উরুযগানী, বার্তা সংস্থা আবনাকে দেয়া সাক্ষাতকারে এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ও কারণ ব্যাখ্যা করেন।

তিনি কথোপকথনের শুরুতে বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে হেরাতে মসজিদের দায়িত্বে নিযুক্ত চারজন আলেম সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ হয়েছেন। একইভাবে এই হামলায় বেশ কয়েকজন শহীদ হয়েছেন।

এই হামলার পিছে সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এই আফগানিস্তানী আলেম বলেন, প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে হাজারা ও শিয়াদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা যাতে শিয়ারা এবং আলেমরা তাদের নিজ এলাকা ও বাড়িঘর ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হতে তথা বাসস্থান ও গ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

আফগানিস্তানের শিয়া ওলামা পরিষদের সহকারী আরও বলেন, শিয়া চিন্তাধারা এবং শিয়া ওলামাদের মধ্যে, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি রয়েছে এবং ইতিহাস সাক্ষী সমাজে শিয়া আলেমগণ আলোকিত ভূমিকা পালন করেছেন। সন্ত্রাসীরা আলেমদের হত্যা করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে চেয়েছে, যাতে তারা মসজিদে, মিম্বারে এবং জনসভায় অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা না বলে এবং মানুষকে জাগ্রত না করে। তাই আলেমদের হত্যা করাই সন্ত্রাসীদের দ্বিতীয় লক্ষ্য। ইতিহাসে প্রতিটি যুগেই মূলতঃ আফগানিস্তানের শিয়া আলেমগণ শিয়াদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ে দাবি জানিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে অবিচল থেকেছেন। তাই সন্ত্রাসীরা প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে শিয়া আলেমরা আর শিয়াদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের চিন্তা না করতে পারে।

জনগণের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ সম্পর্কে হুজ্জাতুল ইসলাম ফাইয়াজ উরুযগানী বলেন, যে সমস্যাটি হাজারা এবং শিয়াদের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, তা হল কান্দাহার, পুলখামরি থেকে হেরাত পর্যন্ত সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড ঘটছে, কিছু মানুষ শহীদ হচ্ছেন কিন্তু নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার দাবীদার তালেবান সরকার না কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, না এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে আর না সন্ত্রাসীদেরকে আটকের চেষ্টা করছে। তালেবানরা কেবল মাত্র একগুচ্ছ প্রশংসাসূচক শব্দ উচ্চারণ করেই সহজেই ঘটনাগুলিকে এড়িয়ে যাচ্ছে।

হেরাতে শিয়া আলেমদের হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীর ক্ষেত্রে তিনটি সম্ভাবনা বিদ্যমান। প্রথম সম্ভাবনা হল স্থানীয় চরমপন্থি গোষ্ঠী, যারা জাতিগত এবং মাজহাবী স্বার্থের কারণে এই হত্যাকাণ্ডগুলি চালাচ্ছে। আমরা খাস আরজোগানে এমনটি দেখেছি, যেখানে মাজহাবী ও জাতিগত কারণে দশ থেকে পনেরো জন মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে।

সন্ত্রাসী হামলার পিছে দায়েশের হাত থাকাকে দ্বিতীয় সম্ভাবনা হিসেবে উল্লেখ করে এই আফগানিস্তানী আলেম বলেন, যদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ এর নেপথ্যে থাকে, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আফগানিস্তানের মাজহাবসমূহের মধ্যে মতভেদ ও ঘৃণা সৃষ্টি করা। কেননা এদেশে শিয়া ও সুন্নি মধ্যে সু-সম্পর্ক রয়েছে এবং একদিকে দায়েশের পৃষ্ঠপোষকরা চায় তাদের মধ্যে বিভাজন ও নৈরাশ্যবাদ সৃষ্টি করতে এবং অপরদিকে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তালেবান সরকারের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে।

তৃতীয় সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, সম্ভাব্য যে তালেবানের মধ্যে তাকফিরিদের একটি দল থাকতে পারে যারা একাজে লিপ্ত হয়েছে। যেমন আগে হেরাত শহরে কট্টরপন্থী তালেবানের আব্দুল মান্নান নিয়াজী নামক ব্যক্তি; শিয়াদেরকে কাফের ফতোয়া দিত এবং শিয়া ও হাজারাদের বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো। এসব হত্যাকাণ্ডে আবদুল মানান নিয়াজীর দল বা শাখার অবশিষ্টরা জড়িত থাকতে পারে, যাদের সঙ্গে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ রয়েছে। তবে এসব মামলায় সাবেক সরকারের অবশিষ্টদের জড়িত থাকার কোন সম্ভাবনা নেই।

হেরাতের জনগণের প্রতি সুপারিশ করে আফগানিস্তানের শিয়া ওলামা পরিষদের সহকারী বলেন, সন্ত্রাসীরা ভীতি সৃষ্টি করতে চায় যাতে মানুষ হেরাত শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। হেরাতের জনগণের প্রতি আমাদের সুপারিশ, যা আগে বলেছি এবং আবারও বলছি, তারা যেন নিজেদের মসজিদ, মিম্বার এবং অঞ্চলকে রক্ষা করে, এজাতীয় চাপকে প্রতিহত করে এবং স্থানান্তরিত হওয়া বা এলাকা ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকে। অন্যদিকে, যদি এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়, তবে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে মাজহাবী বিভেদ সৃষ্টি না হয় কারণ আমরা ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের পক্ষে এবং ধর্মীয় বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টির বিপক্ষে।

পরিশেষে হুজ্জাতুল ইসলাম ফাইয়াজ আরুযগানী বলেন, হেরাত শহরে এখনো আমাদের অনেক আলেম-ওলামা রয়েছে, নিশ্চিতরূপে এমন কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের পরও মসজিদ ও মিম্বারগুলো খালি থাকবে না। আলেমগণ জনগণের সাথে কথা বলেছেন এবং এই অঞ্চলে প্রতিরোধ ও উপস্থিতির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। আমরা জনগণের প্রতিরোধের ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছি; অতএব জনগণকে স্থানান্তর ও দেশত্যাগ থেকে বিরত থাকা উচিত। তদ্রূপ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য রক্ষার উপরও গুরুত্বারোপ করছি, এজন্য জনগণের মতভেদ এড়িয়ে চলা উচিত।#176A